কপ-২৪ সম্মেলন জলবায়ু পরিবর্তনে কতটা কার্যকরী ভূমিকা রাখবে?

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মাছুম বিল্লাহ | 2023-08-28 10:25:06

ফেদাই, আইলা, সিডর, নার্গিস-এর মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে আমরা পরিচিত। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, প্রখর তাপ, জলোচ্ছাস, অসময়ে প্রচণ্ড ঠান্ডা আবার ঠান্ডা যখন আসার কথা তখনও গরম অনুভূত হওয়া এসবের সাথে আমাদের ওঠাবসা একটু বেশিই।

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে পৃথিবী প্রাণীকুলের বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ছে। আর তাই সুন্দরবনের বাঘ প্রায়ই এখন লোকালয়ে চলে আসে এবং হত্যার শিকার হয়। অনেক প্রাণী বিলুপ্তির পথে যা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য এক হুমকি।

এই পরিবর্তন গোটা পৃথিবীজুড়ে। আর এজন্য দায়ী মূলত উন্নত বিশ্বের ব্যাপক শিল্পায়ন। এরই প্রেক্ষিতে পোল্যান্ডের কাটেভিৎসে ১৫ ডিসেম্বর ২০১৮ দুই সপ্তাহব্যাপী কনফারেন্স অফ দ্যা পাটি বা কপ-২৪ সম্মেলন শেষ হলো যেখানে সারাবিশ্বের উষ্ণতাকে ২ ডিগ্রী সেলসিয়াসের নীচে নামানোর সিদ্ধান্তে প্রত্যেক দেশই একমত পোষণ করে।

আমরা জানি, এ শহরেই রয়েছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সবচেয়ে বড় কয়লা কোম্পানি যা বিশ্বে উষ্ণতা ছড়াতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখছে। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ‘বৈশ্বিক উষ্ণতার পরিমাণ কমাতে ২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তি করা হয়েছিল। কিন্তু এ চুক্তি বাস্তবায়নে ব্যর্থতা হবে আত্মঘাতী।’

পোল্যান্ডের জলবায়ু সম্মেলনে দেওয়া ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি আরও বলেন,’পোল্যান্ডে এ সম্মেলন ব্যর্থ হলে তা সবুজ অর্থনীতির অপেক্ষায় থাকা মানুষের কাছে একটি বিপর্যয়মূলক বার্তা পাঠাবে। জলবায়ু পরিবর্তনের এ বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঠেকাতে প্যারিস সম্মেলনে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনের মাত্রা কমানোর যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, তা বাস্তবায়নে অংশগ্রহণকারী দেশগুলো আলোচনা করেছে।

প্যারিস চুক্তিতে শিল্প বিপ্লবের পূর্ববর্তী সময়ে যে তাপমাত্রা ছিল তার চেয়ে দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি না বাড়তে দেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর আগে অক্টোবর মাসে জাতিসংঘের সংস্থা ’ইন্টারগভার্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেটে চেঞ্জ’ বা আইপিসি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

বিশ্বের প্রায় ৯০০ বিজ্ঞানীর যৌথভাবে লিখিত আইপিসির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, এ লক্ষ্য পূরণ করতে চাইলে ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন ৪৫ শতাংশ কমাতে হবে। দুই সপ্তাহব্যাপী এ সম্মেলনের এবারের মূল লক্ষ্য হচ্ছে প্যারিসে স্বাক্ষরিত চুক্তি বাস্তবায়নে একটি নীতিমালা তৈরি করা।

২০১৫ সালে বিশ্বের জলবায়ু নিয়ন্ত্রণে প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয়েছিল কপ-২৩তম সম্মেলন। তিন বছর আগে হয়ে যাওয়া ওই আন্তর্জাতিক সমাবেশে বিশ্বের দু’শটি দেশ অংশগ্রহণ করেছিল।

জাতিসংঘর উদ্যোগে অনুষ্ঠিত বার্ষিক সম্মেলনের ২৪তম সভায় পোল্যান্ডে জড়ো হওয়া এই আন্তর্জাতিক সমাবেশে প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের যৌক্তিক নির্দেশিকা গ্রহণ করে এই কার্যক্রমের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন আশা করেন অংশগ্রহণকারীরা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা যান্ত্রিক কলাকৌশল, প্রযুক্তিবিদ্যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে যে কার্বন ডাই অক্সাইড নি:সরণ হয়, তাকেও নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। তবে কার্বন বাজারের হুমকি সম্মেলনের ধারাবাহিকতাকে সাময়িক সমস্যায় ফেললেও মিলিত হওয়া প্রতিনিধিরা তাকে অতিক্রম করতে বিশেষ বেগ পায়নি। ফলে শেষ অবধি সমাপনী পর্যায়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে চুড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারে।

আলোচকরা বিভিন্ন অধিবেশনে কপ-২৩তম অনুষ্ঠানের জলবায়ু নির্ধারণের নীতিমালা নতুন করে পর্যালোচনা করে কর্মসূচি বাস্তবায়নের ওপর সবার সম্মিলিত অভিব্যক্তি ব্যক্ত করে এত বড় আয়োজনের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। সারাবিশ্বে উষ্ণতা প্রশমনে নিজেদের সময়োপোযোগী কর্মপরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেয়ার প্রত্যয়ও ব্যক্ত করেন তারা।

বিশেষজ্ঞরা বলেন যে, পরিবেশে একটি ক্লাইমেট সাইকেল আছে যা এনসো সাইকেল নামে পরিচিত। এর দুটে ফেজ আছে---একটি ’এল নিনো’ এবং অপরটি ’লা নিনা’। ২০১৫ সালে একটি শক্তিশালী এল নিনো প্যাসিফিক ওশানে তৈরি হয়েছে। ফলে ভবিষ্যতে কী হবে সে সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা করা যায়। এল নিনো, লা নিনার উপর ভিত্তি করে ছয় থেকে নয় মাস আগে মোটামুটি একটা ধারণা তৈরি করা যায়। অর্থাৎ এর উপর ভিত্তি করে ছয় বা নয় মাস আগে বাংলাদেশে খরা হবে না বন্যা হবে সেটি মোটামুটি বলা যায়। কাজেই এর উপর বড় রকমের জাতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। ১৯৯৭ সাল বাংলাদেশের ইতিহাস ছিল সবচেয়ে শুষ্ক বছর। ১৯৯৮সাল ছিল বন্যাপ্রবণ বছর। ২০০৭ সালে সিডরে দশ হাহার মানুষ মারা যায়, সেটা ছিল লা নিনা বছর। ১৯৭৫ সালের আগে দুই থেকে সাত বছর পরপর এল নিনো, লা নিনা হতো। এর মেয়াদ এক থেকে দুই বছর পর্যন্ত। কিন্তু ১৯৭৫ সালের পর থেকে দেখা যায়, প্রায় প্রতিবছরই এল নিনো-লা নিনা হচ্ছে। লক্ষ্যণীয় যে, যে বছর এল নিনো হয়, তার পরের বছর লা নিনা হয়। যেমন ১৯৯৭ ও ১৯৯৮, ১৯৮৭ এবং ১৯৮৮ এবং ১৯৮২ ও ১৯৮৩ সালে একই প্রবণতা দেখা গেছে। এগুলো জলবায়ু পবিরর্তনের সাথে সম্পর্কিত।

আর জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের চতুর্থ ন্যাশনাল ক্লাইমেট অ্যাসেসমেন্ট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র শত শত কোটি ডলার খরচ করলেও লাগামহীন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশটির মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে হুমকির মুখে পড়বে। প্রতিবেদনের উল্লেখ করা হয়েছে, ঐতিহাসিক হারে কার্বন নি:সরণ অব্যাহত থাকলে চলতি শতাব্দীর শেষ নাগাদ কয়েকটি অর্থনৈতিক খাতে বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ শত শত কোটি মার্কিন ডলারে পৌঁছাবে। এ ক্ষতির পরিমাণ বহু রাজ্যের জিডিপির চেয়েও বেশি।

জলবাযুর পরিবর্তন শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ক্ষতি ডেকে আনবে না, সংশ্লিষ্ট এলাকার নারীদের গর্ভের সন্তান মারা যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে কারণ মাটিতে বাড়ছে লবণাক্ততার পরিমাণ। ফসল নষ্ট হচ্ছে, মরে যাচ্ছে মিঠা পানির মাছ, কমে যাচ্ছে বিশুদ্ধ খাবার পানি। সে লবণাক্ত পানি পানের ফলেই বাড়ছে রোগ আর গর্ভের সন্তান মারা যাওয়ার ঝুঁকি।

প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য হচ্ছে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি দুই ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা কিংব সম্ভব হলে এক দশমিক পাঁচ ডিগ্রীর মধ্যে রাখা। তবে, এই লক্ষ্য পূরণ সম্ভব হলেও তা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হবে। সেই ক্ষতি লাগামহীন উষ্ণতা বৃদ্ধির তুলনায় কম। আর এই লক্ষ্য পূরণে দেশগুলোকে কঠোর উদ্যোগ নিতে হবে। এসব বিষয়ে অনেকে অনেক প্রস্তুতি নিয়ে কথা বলেছেন। পোল্যান্ডের জলবায়ু সম্মেলনে আলোচকরা জলবায়ু চুক্তির বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছান। তারা আশা প্রকাশ করেন যে, ২০২০ সালে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি কার্যকর করা সম্ভব হবে।

বিশ্বের ৪০ শতাংশ কার্বন নি:সরণকারী দেশ হলো চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। উন্নত বিশ্ব হতে হলে পুরোপুরি শিল্পায়িত হতে হয়, আর শিল্পায়িত হওয়া মানেই তো পরিবেশ বিপর্যয়। বিশ্বের ১৮০টি দেশের সমর্থনে করা প্যারিস জলবায়ু চুক্তিটির লক্ষ্য বাংলাদেশের মতো জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে আর্থিকভাবে সহায়তা করা যাতে ঝুঁকি মোকাবিলা কিছুটা সহজ হতে পারে। বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রতি বছরই হাজার হাজার মানুষ বাস্তচ্যুত হচ্ছে , তারা মাইগ্রেট করছেন শহরে। বাড়ছে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা। অর্থাৎ জলবায়ুর পরিবর্তন নানামাত্রিক সর্বনাশ ডেকে আনছে। এ থেকে মানবজাতিকে পরিত্রাণ পেতেই হবে। কিন্তু কীভাবে?

আমরা প্রতিদিন হাজার হাজার মন প্লাস্টিক ব্যবহার করছি। প্লাস্টিক পরিবেশের সাথে, মাটির সাথে মিশে যেতে সময় লাগে পাঁচশত বছর। অর্থাৎ আমরা ভয়ানক দুর্যোগ ডেকে আনছি। শিল্পপতিরা সাময়িক লাভের জন্য পলিথিন উৎপাদন করেই যাচ্ছেন আর সাধারণ মানুষও এগুলো ব্যবহার করছে। সরকার দেখেও যেন না দেখার ভান করছে। এখানে নীরব থাকার মানে হচ্ছে ধ্বংস ডেকে আনা। আমরা পাট ও পাটজাত দ্রব্য সহজেই ব্যবহার করতে পারি।

ছোট থেকে, ব্যক্তি পর্যায় থেকে সবাইকে পরিবেশ সচেতন হতে হবে। যতটুকু পারা যায় ততটুকুই অবদান রাখতে হবে তা না হলে এই প্যারিস সম্মেলন আর কাটেভিৎস সম্মেলন করে কতটা লাভবান হবে এই প্লানেট?

মাছুম বিল্লাহ: শিক্ষা গবেষক ও বিশেষজ্ঞ। বর্তমানে ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত সাবেক ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজ শিক্ষক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর