অরিত্রীর আত্মহনন শিক্ষাক্ষেত্রে গভীর ক্ষতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মাছুম বিল্লাহ | 2023-08-17 22:35:29

রাজধানীর ভিকারুন্নেছা স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী অরিত্রীর মৃত্যু নির্বাচনী ডামাডোলের মধ্যেও  রাজপথ থেকে শুরু করে রাজধানীর অলি-গলি, দোকান-পাঠ, অফিস-আদালত ও সামাজিক মাধ্যমকে ভীষণ ব্যস্ত রেখেছে। শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা প্রতিরোধের উপায় নির্ণয়ে একটি জাতীয় নীতিমালা তৈরিতে অতিরিক্ত শিক্ষা সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছেন হাইকোর্ট।অরিত্রীর আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে কমিটিকে। পাঁচ সদস্যের কমিটিতে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিবের নিচে নয়, এমন একজন প্রতিনিধি, শিক্ষাবিদ, মনোবিদ ও অইনবিদদের রাখতে বলা হয়েছে। বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বত:প্রণোদিত হয়ে এ আদেশ দেন।

অরিত্রীর আত্মহত্যার ঘটনায় ক্ষমা চেয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ । তিনি বলেন, বিষয়টি অনাকাঙ্খিত। ঘটনাটি এতদূর গড়াবে তা অনুধাবন করতে পারিনি। এরই মধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে তা মন্ত্রণালয় নির্ধারণ করে দেবে। আত্মহত্যার ঘটনায় আমি সবার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। ইতিমধ্যে অধ্যক্ষসহ তিনজন শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে এবং তাদের মধ্যে একজনকে অ্যারেষ্ট করা হয়েছে।

শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ধরনের ব্যানার হাতে নিয়ে বিক্ষোভ করছে। সেসব ব্যানারের লেখাগুলো খুবই অর্থপূর্ন, সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে ছুঁড়ে দেয়া অনেক প্রশ্ন। তাদের ব্যানারে লেখা এ কেমন শিক্ষক, যার জন্য শিক্ষার্থীকে জীবন দিতে হয়? উই ওয়ান্ট জাস্টিস, টিচিংয়ের  পানিশমেন্ট মৃত্যু কবে থেকে? নো স্টুডেন্ট ডিজার্ভ টু বি ইনসালটেড, এডুকেশন এনলাইটেন আজ, হোয়াই ডাজ ইট কিল আস, উই ওয়ান্ট অ্যানসার্স ফরম দ্যা অথরিটি।

উত্তাল ভিকারুন্নেছা স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাস পরিদর্শনে গিয়ে  শিক্ষামন্ত্রী  শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলেন এবং জানান যে, এ ঘটনায় তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা সকাল থেকে স্কুলগেটের সামনে অবস্থান নিয়েছে, তাদের সাথে বিভিন্ন ধরনের অভিভাবকগনও যোগ দিয়েছেন। শিক্ষার্থীরা বলছে, এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার না হওয়া পর্যন্ত তারা ক্লাসে ফিরবে না। তারা এখন  তিনটি দাবি নিয়ে আন্দোলন করছে। দাবি তিনটি হচেছ- স্কুলটির অধ্যক্ষ ও প্রভাতী শাখার প্রধান শিক্ষককে বহিস্কার, গভর্নিং বডি বাতিল করা ও আত্মহত্যায় প্ররোচনাকারীদের উপযুক্ত আইনে বিচার করা। প্রভাতী শাখার প্রধান শিক্ষককে ইতিমধ্যে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

তরুণ বয়সের শিক্ষার্থীরা ভুল করতেই পারে কারণ তারা এই সমাজেরই অংশ যেখানে বিরাজ করছে   একে অপরকে পেছনে ফেলে যেভাবেই হোক নিজের স্বার্থ উদ্ধার করা, কৌশলে অন্যের চেয়ে নিজেকে শ্রেয় প্রমাণ করা, অসম প্রতিযোগিতা, রাজনৈতিক দৃর্বাত্তয়ন, দুর্নীতির প্রলয়।  শিক্ষার্থীরা সমাজের বাইরে কেও নয়। তারা অন্যায় করলেও  শিক্ষকরা সেই ভুল ধরিয়ে দেবেন, তাকে সঠিক পথে আনার জন্য চেষ্টা করবেন। তাদেরকে কাউন্সেলিং করবেন, চমৎকার আচরণ প্রদর্শন করবেন, আনন্দময় পরিবেশে শিক্ষাদান করবেন। এগুলো সবই একটি আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাছে সমাজের চাওয়া। কিন্তু আমরা কী দেখছি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে? গতকাল অভিভাবকরা বিদ্যালয়টি সম্পর্কে যেসব কথা বলেছেন, তার কয়েকটি এখানে তুলে ধরা হলো।

বিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক বিদ্যালয়ে, ক্লাসে অহরহই নির্মম, মন্তব্য ছুড়ে দেন। তারা তুচ্ছ  ঘটনায় অভিভাবকদের ডেকে আনে। বাবা-মাকে অপমান করা হবে, তাদের বাচ্চা এহেন হীন কাজ করেছে কেন-সেটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে। এ বিষয়গুলো শিক্ষাব্যবস্থার গভীর ক্ষতের কথা তুলে ধরে। এজন্য শুধু কি শিক্ষকগনই দায়ী? শুধুামত্র প্রতিষ্ঠানই দায়ী? আমি বলব সমাজের বিশাল ভাঙ্গনের মধ্যেও শিক্ষকদের দায়িত্ব অনেক বেশি কারণ তারা যে সমাজের অভিভাবক। তাদের সৌজন্যবোধ থাকতে হবে, যাতে সার্বিকভাবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৌজন্যবোধ তৈরি হয়। শিক্ষকদেরই যদি এর অভাব থাকে, তাহলে  শিক্ষার্থীরা কোথায় শিখবে এসব? 

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল বলেছেন, অরিত্রী অমানবিক নিষ্ঠুর নির্মম বিচারের শিকার হয়েছে। শিশু না ভেবে মেয়েটির সঙ্গে প্রাপ্ত বয়স্কদের মতো আচরণ করা হয়েছে। তাকে ও তার পরিবারকে অপমান অপদস্ত করা হয়েছে। মেয়ের সামনে তার বাবাকে অপমান করা হয়েছে। শিক্ষিকার পায়ে ধরে মাফ চাওয়ার পরও মাফ করা হয়নি। আর সেই অপমান সইতে না পেরেই অরিত্রী আত্মহত্যা করেছে।

আত্মহত্যা কখনও প্রতিবাদের ভাষা বা অপমানের প্রতিবাদ হতে পারে না। আত্মহত্যার মতো ধ্বংসাত্মক সিদ্ধান্ত কখনও নেওয়া কারও উচিত নয়। শিক্ষকদের প্যারেন্টিং স্কীল, দুরন্ত ও চঞ্চল শিক্ষার্থীদের কীভাবে মোকাবিলা করতে হবে, চাইল্ড সাইকোলজি, কাউন্সেলিংয়ের ব্যাসিক বিষয়গুলো, কীভাবে সকল শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন কাজে অংশগ্রহণ করাতে হয়, কীভাবে তাদেরকে সম্মান প্রদর্শন করতে হয়, কীভাবে স্ট্রেস ম্যানেজ করতে হয়, কত বয়সের বাচ্চাদের অ্যাটেনশন স্প্যান কত, কোন ধরনের বাচ্চা কতটুকু মানসিক চাপ সহ্য করতে পারে ইত্যাদি জরুরি বিষয়গুলো সকল বিষয়ের শিক্ষকদের জানা উচিত।

আমাদের প্রশিক্ষণ যেগুলো হয় সেগুলো হয় নামের না হয় অর্থের। হঠাৎ করে এক প্রজেক্টে অর্থ এলো, কিছু টিচারদের একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রশিক্ষণ করতে হবে কারণ অর্থতো ব্যয় করতে হবে। শিক্ষকগণ অর্থ পাবেন, একটি সার্টিফিকেট পাবেন, কাজেই অনেকেই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তবে, ঢাকার তথাকথিত ভাল বিদ্যালয়গুলো আবার শিক্ষকদের কোনো ধরনের প্রশিক্ষনে পাঠাতে চান না কারণ তারা মনে করেন তাদের শিক্ষকরা সবার সেরা, তারা সবকিছু জানেন।

আমরা জানি এই প্রতিষ্ঠানে ২০১২ সালেও শিক্ষকদের মানসিক নির্যাতনে নবম শ্রেনির আর এক শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। শিক্ষকদের রূঢ় আচরণে তীব্র অভিমান বুকে নিয়ে ঘুমের বড়ি খেয়ে চিরতরে ঘুমিয়ে গেছে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীটি।

বিদ্যালয়টি সম্পর্কে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি অনেকটাই বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চলছে। এভাবে চললে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তার প্রকৃত চরিত্র হারায়। এক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। শিশু শিক্ষার্থীদের মমতা দিয়ে শিক্ষা দেওয়ার বদলে কোনো কোনো শিক্ষক তাদের ক্লায়েন্ট হিসেবে মনে করে বাণিজ্যিক আচরণই করে চলেছেন।

এত বিশাল শিক্ষার বহর নিয়ে সরকার এমনিতেই আনন্দিত যে এত বিশাল বহর বিশ্বের আর কোথাও নেই। আরও আনন্দিত যে সবাইকে বিনামূল্যে পাঠ্যবই দেওয়া হচ্ছে। কখন তারা এসব চিন্তা করবে? শিক্ষকদের নিজেদেরই উচিত বিভিন্ন সূত্র থেকে শিক্ষা বিজ্ঞানের বিষয়গুলো, শিক্ষার আধুনিক ধ্যান-ধারনাগুলো, শিক্ষা নিয়ে কোথায় কী হচ্ছে এ বিষয়গুলো পড়াশুনা করে জেনে নেওয়া।

আর অভিভাবকদের উচিত তথাকথিত নামকরা বিদ্যালয়ে ভর্তি করে শিক্ষার্থীদের জীবনকে ধ্বংস না করা। ভাল বিদ্যালয় মানে যেখানে শিক্ষকগণ শিক্ষার্থীদের সাথে বন্ধুর মতো আচরণ করেন, প্রকৃত আনন্দের মাধ্যমে পাঠদান করেন, শিক্ষার্থীদের সাইকোলজি বুঝেন, শিক্ষার্থীরা কোন বিষয়ের প্রকৃত জ্ঞান লাভ করে, গভীরে প্রবেশ করে। এ ধরনের বিদ্যালয় কি আমাদের দেশে আছে? শুধু জোর করে পড়া গিলিয়ে পাবলিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়ানোর বিদ্যালয়গুলোকে আমরা এখনও নামকরা ও ভাল বিদ্যালয় বলবো?

মাছুম বিল্লাহ: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক, ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিকে কর্মরত সাবেক ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজ শিক্ষক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর