নির্বাচনী ডিগবাজি এবং প্রার্থী সমাচার

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

ফরিদুল আলম | 2023-08-28 10:13:38

প্রকৃতিতে শীত জেঁকে বসছে ধীরে ধীরে। অনেক অনিশ্চয়তার পর দেশের নির্বাচনী মাঠও এখন সরগরম হয়ে উঠেছে সম্ভাব্য প্রার্থীদের পদচারণায়। তীব্র শীতে যাদের ঘরে ফেরার তাড়া থাকে, নির্বাচনী ডামাডোলে এবার সে জায়গায় ভাটা পড়বে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। চায়ের কাপের গরম ধোয়ার সাথে নির্বাচনের আমেজেরে এক অদ্ভুত সংযোগ।

দেশে নির্বাচন আসে, নির্বাচন যায়, সরকার আসে, সরকার যায়, বহমান স্রোতের মতো এদেশের মানুষ আশার ঘরে বাসা বেঁধে অপেক্ষায় থাকেন সুন্দর আগামীর। দেশ বর্তমানে নির্বাচনকালীন সময় পার করছে। এই নির্বাচনকালীন সময়ে দেশের মানুষের অভিজ্ঞতা হয় এমন কিছু মানুষ দেখার যারা জনদরদী, গরীবের বন্ধু জাতীয়, যারা দলমত, জাতপাত, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলকে বুকে টেনে নিতে পারেন, যারা আদব কায়দায় ভীষণ কেতাদুরস্ত, বয়োজ্যেষ্ঠদের দেখলে কদমবুচি করেন, অন্যের দুঃখ কষ্টে চোখে বৃষ্টি ঝরে।

বাংলাদেশের মানুষ স্বভাবতই আবেগপ্রবণ। প্রবল সেই আবেগের স্রোতে ভেসে কেউ কেউ নির্বাচিত হয়ে আসেন  জনতার ভাগ্য পরিবর্তনের এজেন্ডা নিয়ে। এসব ক্ষেত্রে ভাগ্যের পরিবর্তন হয় বটে, তবে জনতার নয় নিজেদের। তাই সাধু সাবধান।

এক.

মূল আলোচনায় যাবার আগে কিছুটা গৌরচন্দ্রিকা দিলাম এই কারণে যে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা এদেশের জনগণকে আসলে একটা তামাসার বস্তু পেয়ে বসেছেন। দেশের আইনসভার সদস্য হিসেবে যারা নির্বাচিত হবেন তারা তত্ত্বগতভাবে জনপ্রতিনিধি, অর্থাৎ জনগনের প্রতিনিধি, অর্থাৎ জনগনের পছন্দের ব্যক্তি, অর্থাৎ জনগণ যাদের প্রতি আস্থাশীল।

বাস্তবে আমরা কি দেখছি? দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো বর্তমানে তাদের যোগ্য প্রার্থী বাছাই নিয়ে ব্যস্ত সময় অতিক্রম করছে। তাদের পক্ষ থেকে অভিন্ন যে কথাটি বলা হচ্ছে তা হল প্রতিটি আসনে একাধিক প্রার্থী নির্বাচন করতে আগ্রহী হলেও এক্ষেত্রে তাদেরকেই মনোনয়ন দেয়া হবে, যারা উইনেবল অর্থাৎ বিজয়ী হবার ক্ষমতা রাখেন। এই বিজয়ী হবার ক্ষমতা বিষয়টিকে আবার দুভাবে ভাগ করা যায়, প্রথমত, জনগণ যাদের ভোট দিতে চায়, দ্বিতীয়ত, যারা জানে কীভাবে ভোট পেতে হয়। অর্থাৎ একটি হল ভালবাসা, আর অপরটি হল টাকা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে রাজনৈতিক দলের কাছে কোনটি বেশি প্রয়োজনীয়? সবসময় জনগনের ভালবাসায় সিক্ত হবেন এমন প্রার্থী রাজনৈতিক দলের ভেতর ক’জন আছেন? সুতরাং দরকার টাকা ছিটানো। আপাতদৃষ্টিতে বাতাসে যিনি যত টাকা ছিটাতে পারবেন তিনি তত বেশী শক্তিশালী প্রার্থী। ক্ষেত্রবিশেষে বাহুশক্তিও প্রার্থী বাছাইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এধরণের কিছু পেশী শক্তির অধিকারী ব্যক্তিদের প্রতিটি দলেই বিশেষ কদর পেতে দেখা যায়।

দুই.

নির্বাচন আসলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জোটবদল এবং বিশেষত প্রার্থীদের মধ্যে অনেকক্ষেত্রে দলবদলের প্রবণতাও বেশ চোখে পড়ে। সেই সাথে অনেক ছোট দলের নিজস্ব প্রতীক থাকলেও কেবলমাত্র জয়ী হবার তাগিদে বড় দলের প্রতীক ব্যবহারের প্রবণতা এখন অনেকটা নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তত্ত্বগতভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিটি এক একটি নিজস্ব মতাদর্শের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত এবং তাদের প্রতীক পছন্দের ক্ষেত্রেও সেই মতাদর্শের প্রতিফলন দেখা যায়।

এবারের নির্বাচনকে ঘিরেও প্রার্থীদের মধ্যে ডিগবাজির প্রবণতা কমবেশী লক্ষণীয়। বড় দুটি জোটের কিছু ছোট দল ইতোমধ্যে জোটভুক্ত বড় দলের প্রতীকে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছে। এক্ষেত্রে ঐক্যফ্রন্টের অন্তর্ভূক্ত দলগুলো সবাই অভিন্ন প্রতীক ‘ধানের শীষ’ ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলের শরিকরা এবং সদ্য যোগ দেয়া বিকল্প ধারা ‘নৌকা’য় চড়ে তীরে ভেরার সিদ্ধান্ত নিলেও ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্বে মহাজোটের অন্তর্ভুক্ত জাতীয় পার্টি কেবল তাদের নিজস্ব প্রতীক ‘লাঙল’ নিয়ে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এখানে সাবেক রাষ্ট্রপতি বি. চৌধুরীর দল বিকল্প ধারার নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের সাম্প্রতিক সময়ে ক্ষমতাসীন দলের মহাজোটে সামিল হওয়া রাজনৈতিক চাতুরীর একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত। পর পর দুইদফা এবং বিগত ১০ বছর ধরে ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে জনাব চৌধুরী এবং তার দল ব্যাপক সমালোচনায় লিপ্ত থাকলেও শেষ পর্যন্ত ঐক্যফ্রন্ট গঠন প্রক্রিয়া থেকে বাদ পড়ে ক্ষমতাসীন জোটের ছাতিম তলায় ঠাই খোজা নিজেদের অস্তিত্ব অন্বেষণের প্রচেষ্টা ভিন্ন অন্য কিছু হতে পারে না। তিনি যদি ক্ষমতাসীন দলের সাথেই ঘর করবেন তবে কেন এতদিন ধরে বিভিন্ন দলকে একত্রিত করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার চেষ্টা করলেন।

বিএনপি’র সাথেও তার জোটভুক্ত হতে আপত্তি ছিল না, শুধু তার শর্ত ছিল একটাই – বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গ ছেড়ে আসতে হবে। জবাবে বিএনপি ঐক্যফ্রন্টের সামনে নিজের অপরিহার্যতা প্রমাণ করে উল্টো তাকেই জোটছাড়া করল। ভাবতে অবাক লাগে এবং হাসি পায় বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী এবং আসম আব্দুর রবের মত মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী ব্যক্তিবর্গ পর্যন্ত জামায়াত বিএনপি’র সঙ্গী হয়ে তাদের অভিন্ন নির্বাচনী প্রতীক ব্যবহার করতে জোটভুক্ত হয়েছেন এবং বর্তমান সরকারের পতন করে ঐক্যফ্রন্টের সরকার প্রতিষ্ঠিত করে বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার জন্য।

আসলে রাজনীতির চাইতে মজার খেলা বাংলাদেশে আর কিছু হতে পারে না।

তিন.

বেশ মজা পেলাম গত ২০ নভেম্বর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের একটি ঘোষনায়। তিনি সচিবালয়ে তার দপ্তরে সাংবাদিকদের জানান যে বিতর্কিত ব্যক্তিদের এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রক্রিয়া থেকে বাদ দেয়া হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে কক্সবাজারের বর্তমান সাংসদ এবং মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে খ্যাত আব্দুর রহমান বদিকে মনোনয়ন না দিয়ে তার স্ত্রীকে এবং টাঙ্গাইলের সাংসদ এবং বর্তমানে খুনের মামলায় কারান্তরীণ আমানুর রহমান রানার স্থলে তার বাবাকে মনোনয়ন দেয়া হচ্ছে। তিনি আরও দাবী করেন বদি সাহেবের নামে অনেক বদনাম থাকলেও তা কেউ প্রমাণ করতে পারেনি। এখন কথা হচ্ছে তিনি এবং তার দল যদি ব্যক্তি বদিকে ‘বদ’ লোক হিসেবে বিবেচনা না করে থাকেন তবে কেন তাঁকে বঞ্চিত করে তার নিরীহ স্ত্রীকে মনোনয়নের নামে এই পীড়া (!) দেয়া? এই প্রশ্নের উত্তর আসলে সকলের জানা।

জনাব বদির অর্থ এবং প্রভাব দলের জন্য এই মূহুর্তে অনেক প্রয়োজনীয়। দেশের সাধারণ মানুষ বদিকে সাংসদ হিসেবে প্রকাশ্যে না দেখলেও তিনি নতুন করে উদ্ভাসিত হবেন স্ত্রীর আলোয়। গ্রাম দেশে একটা কথা আছে ‘যে লাউ, সেই কদু।’ দেশের মানুষকে কতটা বোকা জ্ঞান করলে একটি দলের পক্ষ থেকে সেই দলের সাধারণ সম্পাদক এমন মন্তব্য করতে পারেন!

সবশেষে, হিরো আলম নামে বগুড়ার এক যুবক, সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত মডেল, যে তার অদ্ভুত কর্মকাণ্ডে বেশ আলোচিত, এবারের নির্বাচনে একটি দলের হয়ে মনোনয়ন চেয়েছেন এবং প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন যে বিজয়ী হলে তিনি মন্ত্রীও হতে পারেন। আমাদের দেশের কিছু মানুষ এবং গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিয়ে বেশ ঠাট্টা মশকরায় মেতে উঠতে দেখা গেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে একজন ব্যক্তিকে নিয়ে এধরনের তামাসা করাকে অসুস্থতার লক্ষণ বলে মনে করি। একজন চানাচুর বিক্রেতা থেকে আজকের হিরো আলম হয়ে ওঠা ব্যক্তিটি আমাদের তথাকথিত ‘পলিশড’ সমাজে হাসি এবং তামাসার বস্তুতে পরিণত হলেও তার আজকের অবস্থান কষ্টার্জিত এবং শ্রম ও ঘামে গড়া।

রাজনীতিতে ডিগবাজী যদি অপরাধ না হয়, অর্থ, অস্ত্র আর পেশী শক্তির প্রদর্শন যদি স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে পরিগণিত হয়, আদর্শের নামে যেনতেন প্রকারে স্বার্থ হাসিল যদি জায়েজ বলে বিবেচিত হয় তবে হিরো আলমও একজন প্রার্থী হিসেবে অনেকের চাইতে যোগ্য হতে পারেন।

ফরিদুল আলম: সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে বেইজিং এর ইউআইবিই-তে উচ্চশিক্ষারত।

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর