আরও সংকটে খালেদা, ঐক্যফ্রন্টই কি বিএনপির শেষ আশ্রয়?

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

ফরিদুল আলম | 2023-08-30 18:36:46

এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ৫ বছর সাজা ঘোষণার পর ২৯ অক্টোবর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায়ে বেগম খালেদা জিয়ার ৭ বছরের সাজা ঘোষণা করা হল। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় তিনি উচ্চ আদালতে আপিল করেছেন এবং আজ এ মামলায় তার সাজা ৫ বছর থেকে বাড়িয়ে ১০ বছর করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে বেগম জিয়া দুটি মামলায় মোট ১৭ বছরের জন্য দণ্ডিত হলেন। যদিও চ্যারিটেবল মামলায় তিনি উচ্চ আদালতে আপিল করবেন। কিন্তু আপিল নিষ্পত্তিতে তিনি খালাস পাবেন কি না সেটা বলা মুশকিল কেননা মামলা দুটি এতটাই স্পর্শকাতর এবং এমন গুরুত্বপূর্ণ আলামতের ভিত্তিতে নিষ্পত্তিকৃত যে এক্ষেত্রে তার পরিণতি পরিবর্তনের সম্ভাবনা খুব কমই আছে বলা যায়।

এই মামলায় বেগম জিয়া ছাড়াও রয়েছেন তার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধূরী এবং অপর দুই আসামি। আসামিদের প্রত্যেককেই একই দণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে। এর আগে যখন জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায় ঘোষণা করা হয় তখন তারেক রহমানকে ১০ বছরের সাজা দেয়া হলেও আদেশে মাননীয় আদালত বলেছিলেন যে বয়স বিবেচনায় বেগম জিয়াকে ৫ বছরের সাজা দেয়া হয়েছে। গতকালের চ্যারিটেবল মামলার আদেশে সম্ভবত এধরণের কোনো বিবেচনা থেকে রায় ঘোষিত হয়নি।

গতকালের মামলার রায় ঘোষণার ক্ষেত্রে কিছুটা অনিশ্চয়তা ছিল বেগম জিয়ার অনুপস্থিতিতে এই রায় প্রদান আইনসম্মত কি না সে বিষয়ে সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তের অপেক্ষার কারণে। গতাকাল সকালে সর্বোচ্চ আদালত বেগম জিয়ার আবেদন খারিজ করে দিলে এই রায় দেয়ার পথে প্রতিবন্ধকতা দূর হয়। আমরা জানি এর আগে তার পক্ষ থেকে এই মামলার বিচারকার্য দীর্ঘায়িত করার জন্য নানাভাবে কালক্ষেপণ করা হয়েছিল, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল তার বারবার আদালতে অনুপস্থিতি। অবশেষে সরকারের সিদ্ধান্তে কারাগারের অভ্যন্তরে আদালত স্থাপন করে বিচারের ব্যবস্থা করা হলেও তিনি সেখানে একবার উপস্থিত হয়ে শারীরিক অসুস্থতার কারণে আর উপস্থিত হওয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়ে যান। অগত্যা বাকী বিচারকার্য তার অনুপস্থিতেই সম্পন্ন হয়। এটা নিয়েও পরবর্তিতে বিএনপির পক্ষ থেকে উচ্চ আদালতে গিয়ে নিরাশ হতে হয়।

এমন এক সময় এ দুটি মামলার রায় ঘোষিত হল যখন নির্বাচন তফসিল ঘোষণার আর বাকী আছে হয়ত সপ্তাহখানেক। এই মামলার রায়ে বেগম জিয়াতো বটেই, তার রাজনৈতিক দলের জন্যও অনিশ্চয়তা আরও বেড়ে গেল। বিএনপি যথারীতি বেগম জিয়া এবং তার পুত্র বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের প্রতিটি মামলা এবং এর রায়কে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে অভিহিত করে আসছেন। এধরণের অভিযোগ যেমন অসত্য নয়, একইভাবে এধরণের প্রতিটি মামলার সাথে তাদের সম্পৃক্ততাকেও অস্বীকার করার সুযোগ নেই।

দেশের রাজনৈতিক সরকারের ইতিহাসে এখন অবধি কোনো দলের শাসনকালকেই দুর্নীতির উর্ধ্বে রাখার সুযোগ নেই। তবে দুর্নীতির অভিযোগে ক্ষমতা হারানো রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বিচার করার সুযোগ সবসময় রাজনৈতিক সরকারের জন্য হয়ে ওঠে না এবং সেটার কারণও রাজনৈতিক।

আমরা যতই গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার জন্য সংগ্রাম করিনা কেন, বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে গণতন্ত্র আসলে জনগণের স্বার্থে এধরণের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারে কি না সেটা নিয়ে রয়েছে বিস্তর সন্দেহ। রক্ষক যখন ভক্ষক হয়, জনগণের তখন অসহায়ের মত তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। সেজন্য রক্ষকদের কখনও অপর রক্ষকের বিচারে আগ্রহী দেখা যায় না। আবার রক্ষকের বিচারে যখন তৎপর হয় অপর রক্ষক, তখন বুঝতে হবে এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বী যেন রাজনৈতিকভাবে আর উঠে দাঁড়াতে না পারে।

এর আগে আমরা দেখেছি স্বৈরশাসক এরশাদের বিচার করতে, যাকে নিয়ে এখন রাজনৈতিক দলগুলো রীতিমত কানামাছি খেলা খেলে চলছে। তিনিও একবার এর তো আরেকবার তার হয়ে ডিগবাজি দিয়ে বেড়াচ্ছেন। বিএনপির ক্ষেত্রেও এখন ঘটে চলছে এমন ঘটনাই। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! এরশাদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল তাদের আমলেই। বর্তমানে মুক্ত বাতাসে সাবেক স্বৈরশাসক নিশ্চয়ই পরম তৃপ্তির হাসি হাসছেন।

আমার উপরের লেখা থেকে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের কেউ কেউ হয়তো ক্ষুব্ধ হতে পারেন। তাদের ক্ষোভ প্রসমনে আগেই বলে রাখি যে আমি ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত খুশী হয়েছি এই কারণে যে অপরাধীকে বিচারের সম্মুখীন করা হয়েছে। তবে আশান্বিত হতে পারছি না এই কারণে যে বিএনপির মত আমি এবং আমার মত আমজনতার অনেকেই মনে করবেন এটি যতটুকু না দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের একধরণের আদর্শিক অবস্থান, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিকভাবে বিএনপিকে নির্মূল করার এক প্রয়াস।

বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন হয়ে একদিকে তাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বিগত বিএনপি এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দায়ের হওয়া সকল মামলা প্রত্যাহার করে নেয়, যেখানে বিএনপিসহ অপর রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত কোনো মামলা প্রত্যাহার করা হয়নি। একই কাজ বিএনপি ক্ষমতায় থাকতেও করেছে। তারাও কেবল তাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাই প্রত্যাহার করেছে। আজকে সরকারের বিএনপির বিরুদ্ধে বিশেষ করে শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে এই কঠোরতার মূল কারণ হচ্ছে সুযোগের সদ্ব্যবহার। আমি নিশ্চিতভাবে একথা বিশ্বাস করি যে আজকের বিএনপির যদি রাজপথে সেধরণের শক্তিমত্তা থাকত তাহলে কোনোভাবেই বেগম জিয়াকে কারাগারে প্রেরণ করা সম্ভব হতোনা এবং তার জামিনের বিষয়টিও এত দীর্ঘ সময় ঝুলে থাকতো না। রাজপথে তাদের এই শক্তিমত্তার ঘাটতির সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে বিএনপির বিগত ২০১৪ সালের নির্বাচন পূর্ব সময়ের সন্ত্রাসী আন্দোলন, যা জনগণ তখন ব্যাপকভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিল, এবং পরবর্তিতে যার সুযোগ নিয়েছে সরকার।

সরকার যখন দেখল সেই ঘটনাকে বার বার সামনে নিয়ে এসে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব এবং এর ফলে দলটিকে প্রয়োজনে রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া করার সুযোগ রয়েছে, তারা আর দেরি করেনি। সেই পথেই হাঁটছে এখন। বিচার হয়েছে এবং হচ্ছে এবং তা দুর্নীতির যথাযথ অভিযোগে। আদালতের রায় এবং এখতিয়ার নিয়ে কোনো কথা বলতে চাই না। কারণ, বিষয়টি সাবজুডিস।

এটা নির্বাচনের বছর। নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এক ধরণের প্রতিযোগিতা চলতে থাকে কোন দল জনগণের সামনে নিজেদের কতটুকু যৌক্তিকভাবে উপস্থাপনের পাশাপাশি অপর দলের দুর্নীতি এবং অপশাসনের প্রামাণ্য দলিল উপস্থাপন করতে পারে। এক্ষেত্রে নির্বাচনের আগে আগে অনেকটা গরম চায়ের ধোয়া ওড়ার মত আদালতের রায় আওয়ামী লীগের জন্য মেঘ না চাইতেই জলের মত আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়াল। এখন জনগণ বিষয়গুলোকে কোন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার বিবেচনা করবে সেটা একান্তই তাদের বিষয়। তবে এতকিছু নিয়ে জনগণ হয়ত মাথা ঘামাত না যদি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় পর্যন্তই চূড়ান্ত বিচারিক প্রক্রিয়া থেমে থাকত।

বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক ভবিষ্যত নিয়ে খানিকটা আলোচনা করা যাক। বিএনপি সমর্থকরা হয়ত শুনলে মনে কষ্ট পাবেন যে বয়সের কারণেই হোক কিংবা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে অক্ষমতার কারণেই হোক তার রাজনৈতিক ভবিষ্যত বলতে আর কিছুই এই মুহূর্তে অবশিষ্ট নেই। আর এর শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালের তথাকথিত নির্বাচনের পূর্ব থেকে বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলন সংগ্রামের সময়। সে সময় ৩ মাসাধিককাল নিজ কার্যালয়ে অবস্থান নিয়ে জনগনের সামনে সরকারকে দায়ী করা এবং লন্ডন থেকে আমদানী করা সিদ্ধান্তে দল এবং আন্দোলন চালানো এবং সবশেষে দশম নির্বাচন বর্জন করা কেবল খালেদা জিয়া নয়, তার বিকল্প নেতৃত্ব তারেক রহমানকেও দলের কাছে একটা অপ্রয়োজনীয় বোঝায় পরিণত করেছে।

কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতৃত্বের এই অক্ষমতা মাঠ পর্যায়ের নেতৃত্বকে নিস্তেজ করে দিয়েছে। ৫ বছর পর তাদের দলের এখন উপলব্ধি হয়েছে যে নির্বাচন বর্জন করার আর সুযোগ নেই, আবার একক সামর্থ্যও নেই সরকারকে চ্যালেঞ্জ করার। তাই তারা এখন সওয়ার হয়েছে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে। এদিকে ড. কামাল হোসেন তার ব্যক্তিজীবনের এতদিনকার এত অর্জন নিয়ে বিতর্কিত হচ্ছেন বিএনপির সাথে জোটবদ্ধ হওয়ার কারণে। এর কারণ এই বিএনপি কেবল নিছক বিএনপি নয়, তারাও রয়েছে ২০ দলীয় জোটের নেতৃত্বে (বর্তমানে ১৮ দল), যেখানে তাদের কাধে রয়েছে জামায়াতের ভূত, রয়েছে নানাবিধ দূর্নীতির মামলা, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা। আর সেজন্যই অনেকেই বলছেন, খালেদা এবং তারেকের বিকল্প হিসেবে ড. কামাল হোসেন আসলে ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে বিএনপিকেই আবারো রাজনীতিতে পুনর্বাসনে নেমেছেন।

আমরা জানি, সরকার বিরোধী নতুন জোট ঐক্যফ্রন্ট সরকারের কাছে ৭ দফা দাবি পেশ করেছে, যেখানে বেগম জিয়াসহ অপর রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির দাবিও রয়েছে। একটি নির্বাচনের আগে যখন এধরণের জোট গড়ে ওঠে তখন এধরণের জোট ক্ষমতাসীন না হলে দীর্ঘস্থায়িত্বের নিশ্চয়তা দেয় না। এতদিন বিএনপির পক্ষ থেকেই কেবল তার মুক্তির আন্দোলন সীমাবদ্ধ ছিল, বর্তমানে কণ্ঠ মিলিয়েছে ঐক্যফ্রন্ট। নির্বাচনের ফলাফল যফি ফ্রন্টের অনুকূলে না যায়, তবে এর তাৎক্ষণিক প্রভাব কেবল বেগম জিয়া নয় আরও নিদারুণভাবে পরবে তার নিজ দলের ওপরও।

ফরিদুল আলম: সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে বেইজিং এর ইউআইবিই-তে উচ্চশিক্ষারত।

এ সম্পর্কিত আরও খবর