ভোটের মাঠে জোটের খেলা

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

ফরিদুল আলম | 2023-08-23 05:48:09

শেষ পর্যন্ত রাজনীতিতে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়ে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে যাত্রা শুরু করল জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত অন্যতম ধারক বিকল্প ধারাকে বাদ দিয়ে বৃহত্তর ঐক্য গঠনের লক্ষ্যে যুক্ত করা হয়েছে বিএনপিকে। অবশ্য বিকল্প ধারার একটি অংশ দল থেকে বিচ্যুত হয়ে নিজেদের আসল বিকল্প ধারা হিসেবে দাবি করে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে। যদিও নির্বাচনী তফসিল এখনও ঘোষিত হয়নি, ধরা যায় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার মাসখানেক আগে সরকারবিরোধী জোটের একটি আকার আপাতত জনসম্মুখে উন্মোচিত হল। একথা বলছি একারণে যে আগামী ১ নভেম্বর মহামান্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সাক্ষাতের দিনক্ষণ চূড়ান্ত হয়েছে। রীতি অনুযায়ী তফসিল ঘোষণার আগে রাষ্ট্রপতির সাথে নির্বাচন কমিশনের সামগ্রিক প্রস্তুতির বিষয়টি ব্রিফ করা হয়ে থাকে। সেই ধারণা থেকে বলা যায় এই সাক্ষাতের পরপরই হয়ত কমিশনের পক্ষ থেকে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করা হবে।

তাছাড়া সংবিধান অনুযায়ী যেহেতু আগামী বছরের ২৮ জানুয়ারির মধ্যে একাদশ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে সেই দৃষ্টিকোণ থেকেও নির্বাচনের ক্ষণ গণনার সময়ও প্রায় চলে এসেছে। যাহোক আলোচনার সূত্রপাত করেছিলাম মূলত দেশের রাজনীতিতে নয়া জোটগঠন নিয়ে, যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে আগামী নির্বাচন।

আমাদের দেশে নির্বাচনের আগে জোট গঠন এবং জোট ভাঙ্গা নতুন কিছু নয়। এই বিষয়টি নির্বাচনের আগে বিশেষ বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। সেই বিবেচনায় এবারের আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জোট ভাঙা গড়ার প্রক্রিয়া অনেকটা দেরিতেই শুরু হয়েছে বলা চলে। এর প্রধান কারণ বিএনপি। আমি এর আগেও আমার অনেক লেখায় বলেছি যে উন্নত দেশগুলোতে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা অনেক বেশি নয়, সেই তুলনায় আমাদের দেশে গণতন্ত্রের নামে মাত্রাতিরিক্ত রাজনৈতিক দল উন্নয়নের পথে অনেক বেশি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। বড় দলগুলোর মধ্যে সর্বদা বিরাজমান অসুস্থ প্রতিযোগিতার সাথে নির্বাচনের আগে খুচরা দলগুলোর সন্নিবেশ সেধরণের প্রতিযোগিতাকে আরও অসহনীয় করে তোলে।

বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জন করলেও আমাদের গণতন্ত্রের অভিযাত্রা শুরু হয় স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের পর। আমরা ৯০ পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতির পর্যবেক্ষণে দেখব যে সেই সময় থেকে শুরু করে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, প্রতিটিতেই বড় দুই দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের নেতৃত্ব মেনে নিয়েই অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলো তাদের সাথে জোটবদ্ধ হয়েছে। সে তুলনায় এবারই প্রথম আমরা দেখছি যে সরকারবিরোধী প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি তাদের নির্বাচনমুখী কৌশল পরিবর্তন করে নিজেরা গিয়ে সওয়ার হয়েছে অপর জোটে, যেখানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ড. কামাল হোসেন। এক্ষেত্রে নির্বাচনে বিজয়ী হলে কোন প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র শাসিত হবে সে বিষয়টি জনসম্মুখে স্পষ্ট না হলেও যেকোনো উপায়ে বর্তমান সরকারের পতন ঘটিয়ে নতুন একটি সরকার গঠনের তাগিদ রয়েছে, যেখানে নিশ্চিত করে বলা চলে বিএনপির একক কোনো প্রাধান্য থাকবে না।

একটি কথা ভাবতে বেশ অবাক লাগে যে প্রতিটি দলই যেখানে নির্দিষ্ট আদর্শ এবং লক্ষ্যকে সামনে রেখে তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচী নির্ধারণ করে, সেখানে নির্বাচনের আগে জোট বা মহাজোটের মাধ্যমে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর অপরাপর জোটভুক্ত দলগুলোকে আস্থায় রেখে কীভাবে তাদের দলীয় লক্ষ্য এবং আদর্শের আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। এক্ষেত্রে আমরা বিএনপি শাসনামলে ৪ দলীয় জোটের সাথে জামায়াতে ইসলামির অন্তর্ভূক্তির মধ্য দিয়ে তাদের শাসনামলের পুরোটা সময় সরকারের ভেতর জামায়াতের একধরণের প্রচ্ছন্ন প্রভাব লক্ষ্য করেছি। একই বিষয় আমরা দেখতে পারছি বর্তমান সরকারের মহাজোট নাম ধারণ করে সরকার গঠনের পর থেকে। যেখানে স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে ৯ বছর রাজপথে সংগ্রাম করে তার পতন ঘটানো হল, তারই দলের সাথে নির্বাচনী জোট করে যে সরকার গঠিত হল, তা সর্বাংশে আওয়ামী লীগ এবং মুক্তযুদ্ধের আদর্শ তথা বঙ্গবন্ধুর নীতির আলোকে পরিচালিত হওয়ার পুর্ণাঙ্গ নিশ্চয়তা প্রদান করে না।

আমরা এক্ষেত্রে যে মর্মান্তিক চিত্রটি অবলোকন করি তা হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে বড় দলগুলো জোটভুক্ত ক্ষুদ্রতর দলগুলোকে ক্ষমতারোহণের লক্ষ্যে আস্থায় রাখতে তাদের দীর্ঘদিনের সাংগঠনিক ত্যাগ তথা তৃণমূলের সংগ্রামকে বলি দিয়ে দেয়। ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের কথা বলা হলেও দলীয় ত্যাগী প্রার্থীদের বঞ্চিত করে জোট টিকিয়ে রাখার স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধে বিতর্কিত ভূমিকা পালনকারী ব্যক্তিদের নির্বাচিত হবার সুযোগ করে দেয়া হয়। এধরণের জোটগত রাজনীতি আমাদের জাতীয় জীবনে ক্রমাগতভাবে সর্বনাশ ডেকে আনছে।

আমরা যদি বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির আলোকে দেশের ভবিষ্যত সরকারের একটা সম্ভাব্য চিত্র দেখার চেষ্টা করি তবে দেখব রাজনীতিতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামক যে জোটের নব উত্থান ঘটল সেখানে তাত্ত্বিকভাবে বিএনপির একক প্রাধান্য না থাকলেও নির্বাচনের আগে এবং পরের সময় নিয়ে এই জোটের সম্ভাব্য একটা চিত্র দাঁড় করানো যেতে পারে। নির্বাচনের আগে এই জোটের দলগুলোর মধ্যে আসনবন্টনজনিত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। এখানে নিঃসন্দেহে অপর দলগুলো তাকিয়ে থাকবে বিএনপির ওপর যে তাদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ কতগুলো আসন দরকষাকষির মাধ্যমে আদায় করা যায়।

এক্ষেত্রে বিএনপি একটি জোটে আনুষ্ঠানিকভাবে ঢুকলেও তারা ২০ দলীয় জোট নামক অপর একটি দলের নেতৃত্বে রয়েছে, যদিও শোনা যাচ্ছে সম্প্রতি দু'টি দল সেখান থেকে বের হয়ে গেছে। এই জোটে জামায়াতে ইসলামী তাদের অনেক পুরাতন এবং অবিচ্ছেদ্য অংশ। অর্থাৎ নির্বাচনের সময় তাদের নেতৃত্বাধীন জোটের অপরাপর শরীক দলের জন্যও আসন ছেড়ে দেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তাহলে দাঁড়াল কী? বর্তমান ঐক্যফ্রন্ট যেখানে তাদের লক্ষ্যের মধ্যে অন্যতম হিসেবে উল্লেখ করেছে যে যুদ্ধাপরাধীদের সাথে কোনো ঐক্য হবে না, সেক্ষেত্রে এই জোট যদি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন হয় তবে কি এটা বলার অধিকার রাখবে যে জামায়াতকে সেই সরকারের অংশীদার করা যাবে না?

আরেকটি বিষয় হচ্ছে, বিএনপি ছাড়া ঐক্যফ্রন্টের দলগুলোর নিজেদের প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়ার অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। তবে কি এক্ষেত্রে তারা জনপ্রিয় প্রতীক হিসেবে বিএনপির ধানের শীষকে বেছে নেবে? যদি তাই হয় তবে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বের মাহাত্ম রইল কোথায়? তবে কি এখানে বিএনপিকে যে কোনোভাবে ক্ষমতাসীন করার জন্য ড. কামালকে ব্যবহার করা হচ্ছে? ড. কামাল কি তার জ্ঞাতসারে নাকি অজ্ঞাতসারে এর সাথে শামিল হয়েছেন তা তিনিই বলতে পারবেন।

এবার আসি ক্ষমতাসীন দলের বিষয়ে। টানা প্রায় ১০ বছর রাষ্ট্র পরিচালনায় নানান ক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য এবং ক্ষমতায় থাকার সুবাদে তাদের চাপ অনেকটাই কম। কিন্তু এক্ষেত্রে তাদের আপস করতে হচ্ছে যথারীতি একসময়ের প্রতাপশালী স্বৈরশাসক এরশাদের দলের সাথে। একই সাথে সরকারের কাধে সওয়ার হওয়া বাম আদর্শিক রাজনৈতিক দল, যারা সরকারকে সহায়তার বিনিময়ে মূলত নিজেদের রাজনৈতিক ফায়দা আদায় করেছে। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে প্রবলভাবে বিরোধীতাকারী এই দলগুলোর সাথে সরকারের এখন দারুণ সখ্য। সুতরাং এদেরসহ বিদ্যমান মিত্রদের সাথে সখ্যতা বজায় রেখে নির্বাচন করাটা তাদের জন্য মোটেও কঠিন কোনো কাজ নয়। তাদের এটাও মনে রাখতে হবে যে এবারের নির্বাচন যেহেতু অংশগ্রহমূলক হতে যাচ্ছে সেহেতু- ‌‌আমার ভোট কিন্তু আমিই দেব‌।

ফরিদুল আলম: সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে বেইজিং এর ইউআইবিইতে উচ্চশিক্ষারত।

এ সম্পর্কিত আরও খবর