থ্রি ‘ডি’ ও উইপোকা সমাচার

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

শুভ কিবরিয়া | 2023-09-01 22:44:23

এক.

থ্রি ‘ডি’ শব্দ একসময় খুব ব্যবহৃত হতো ডায়াবেটিক আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে। বলা হয় ডায়াবেটিক নিরাময়যোগ্য রোগ নয়। তবে চেষ্টা করলে একে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। এই চেষ্টার একমাত্র মাধ্যম হলও থ্রি ‘ডি’। তিন ‘ডি’ - ডায়েট, ড্রাগ , ডিসিপ্লিন। অর্থাৎ নিয়মমতো খাওয়া , প্রয়োজনীয় ঔষধ আর শৃঙ্খলাময় নিয়মানুবর্তি জীবনযাপন করতে পারলেই ডায়াবেটিক রোগকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। ডায়াবেটিক নিয়ন্ত্রণে থাকলে খুব অসুবিধার কিছু নেই কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিক শরীরের জন্য খুবই ক্ষতিকর। ডায়াবেটিক নিয়ন্ত্রণে না থাকলে শরীরের লিভার, কিডনি, চোখ , কান সবই একে একে আক্রান্ত হয়ে জীবন হানির কারণ হতে পারে। তাই ডায়াবেটিক রোগীরা এই তিন ‘ডি’ নিয়ে খুব সচেতন থাকে।

হালে আরেক থ্রি ‘ডি’ আবির্ভূত হয়েছে রাজনীতির কল্যাণে। আজকের দুনিয়ায় রাজনীতির নতুন আবির্ভাব হচ্ছে ভেদনীতি। মানুষে মানুষে নানা উপায়ে বিভাজন টেনে রাজনীতি নিজের ফায়দা নিচ্ছে। সেইরকম এক রাজনীতির শক্তিমান উত্থান ঘটেছে ভারতে ধর্মবাদি দল বিজেপির কল্যাণে। বিজেপির চেষ্টায় আদালতের মাধ্যমে ভারতের আসাম রাজ্যে শুরু হয়েছে সেই দেশের বাংলাভাষী মুসলমান খেদানো এক নতুন প্রক্রিয়া। সেখানে তৈরি হয়েছে নাগরিক পঞ্জি বা এনআরসি। এই তালিকা অনুয়ায়ি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে যেসব মানুষ আসামে গিয়েছেন বলে তার সপক্ষে নথি প্রমাণ করতে পারেননি তাদের নাগরিক তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। প্রায় ৪০ লাখ লোক এই তালিকার আওতায় এখন রাষ্ট্রহীন নাগরিক হবার আশংকায় পড়েছে। ভারতের পক্ষে বলা হচ্ছে এইসব লোক ভারতে অনুপ্রবেশকারি। এরা বাংলাদেশ থেকে আসামে ঢুকেছে। বিজেপি এই সব কথিত অনুপ্রবেশকারিদের সম্পর্কে তাদের কর্তব্য স্পষ্ট করেছে। বিজেপির সর্বভারতীয় সম্পাদক রাম মাধব খুব স্পষ্ট করে এইসব কথিত অভিবাসি সম্পর্কে তাঁর থ্রি ‘ডি’ থিওরি দিয়েছেন।

তাঁর কথিত থ্রি ‘ডি’ হচ্ছে- ডিটেকশন, ডিলিট, ডিপোর্টেশন। প্রথম ‘ডি’, ডিটেকশন মানে , বিদেশিদের চিহ্নিত করা। দ্বিতীয় ‘ডি’, ডিলিট মানে, বাদ দেয়া। অর্থাৎ ভোটার তালিকা থেকে এইসব চিহ্নিত অভিবাসিদের নাম কেটে সকল রকম সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা। যাতে প্রকৃত ভারতীয় নাগরিকদের সুখ সুবিধা বৃদ্ধি পায়। তৃতীয় ‘ডি’ ডিপোর্টেশন এই প্রক্রিয়ার শেষধাপ। নাগরিক পঞ্জিতে যাদের নাম উঠবে না , সেই বিদেশিদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো।

বিজেপির সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের পর, সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহও এ বিষয়ে মুখ খুলেছেন। অমিত শাহ সম্প্রতি রাজস্থান ও দিল্লিতে দুটি জনসভায় ভারতে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশকারীদের ‘উইপোকা’র সঙ্গে তুলনা করেন। অমিত শাহ বলেন, অনুপ্রবেশকারীরা প্রকৃত ভারতীয়দের অধিকার হরণ করছে। রসদে ভাগ বসাচ্ছে। উইপোকার মতো ভেতর থেকে দেশকে কুরে কুরে খাচ্ছে। ওদের প্রত্যেককে খুঁজে বের করা হবে। তারপর ফেরত পাঠানো হবে।

দুই.

এটা এখন স্পষ্ট ভারতের সংসদ নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে বিজেপি ততো ভেদনীতিকে প্রমোট করে কট্টর হিন্দু ভোট ব্যাংকের নিরঙ্কুশ আনুকূল্য পেতে চাইছে। তাই ‘বিদেশি খেদাও’ কর্মসূচিকে বিভিন্ন রাজ্যে বাড়াতে চাইছে। আমেরিকায় ট্রাম্প যেমন বলে বেড়াচ্ছেন অভিবাসিদের সুযোগ দিতে যেয়ে মূল আমেরিকানরা চাকরি বাকরিসহ সকলরকম নাগরিক সুবিধায় কম সুযোগ পাচ্ছেন, তাই অভিবাসি খেদানোই আমেরিকার মূল লক্ষ্য। ভারতেও বিজেপির পৌরহিত্যে সেই সুর উঠছে। আসামে এই ব্যবস্থা রাজনৈতিক কারণে সুপ্রিম কোর্টের হাত ধরে নাগরিক পঞ্জির নিশানায় বাস্তবায়ন করা গেছে। বিজেপি আসামের এই সাফল্য এখন পশ্চিমবঙ্গসহ অন্যান্য রাজ্যেও বিস্তার ঘটানোর জন্য এগিয়ে চলেছে।

যেহেতু ভারতের সর্বত্রই পিছিয়ে পড়া মানুষের কমতি নেই সেই কারণে ‘বিদেশি খেদাও’ ডাকের এক ধরণের জন আবেদনও আছে। পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জি, বিজেপির এই রাজনীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন। তিনি বাংলাভাষী মুসলমানদের পক্ষে কড়া অবস্থান নিয়েছেন। সেটাও একটা রাজনীতি। কেননা পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানরা মমতা ব্যানার্জিও বড় ভোট ব্যাংক।

তিন.

ভারতের আসামে ৪০ লাখ লোক রাষ্ট্রহীন হলে বাংলাদেশের অসুবিধা কি?

এক. প্রথমত, এইসব লোককে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারি বলে বাংলাদেশে পাঠানোর চেষ্টা চলবে। ভারতীয় মনস্তত্বে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারির ভাবনা খুব শক্তভাবেই আছে। বছরের পর বছর ধরে যারা ভারতে বসবাস করছেন তারা কলমের এক খোঁচায় বিদেশি হয়ে যাবেন আর তাদের ভার বইতে হবে বাংলাদেশকে এটা কোনো যুক্তি হতে পারে না। রাষ্ট্র ও রাজনীতির বিবেচনায় এটা বাংলাদেশের জন্য অসম্মানজনক বিষয়। হালে এসব বিষয়ে ভারতের রাজনীতিবিদরা যে ভাষায় কথা বলছেন তা ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রেও ভবিষ্যতে বড় বাধা হয়ে উঠতে পারে।

দুই. বাংলাদেশ এমনিতেই রোহিংগা শরণার্থীদের ভারে ভারাক্রান্ত। এই রোহিংগা শরণার্থীদের কবে নাগাদ স্বস্তির সাথে মিয়ানমারে পাঠানো যাবে তা বলা মুশকিল। লাখ লাখ রোহিংগা শরণার্থীর উপস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনীতি, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশের ওপর বড় ধরণের চাপ তৈরি করছে। নতুন করে এ ধরণের চাপ সামলানোর ক্ষমতা বাংলাদেশের আর নেই।

তিন. ভারত যে ভেদনীতির ওপর ভর করে এই ‘বিদেশি খেদাও’ কর্মসুচির বিস্তার ঘটাচ্ছে তা বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য স্বস্তিকর নয়। কেননা এই অ্যপ্রোচে আছে সাম্প্রদায়িক মনোভাব। কেন্দ্রিয় বিজেপি সরকার আস্বস্ত করেছে যে, যাঁরা হিন্দুধর্মীয় বিশ্বাসের অনুসারী, এনআরসিতে (নাগরিক পঞ্জি) নাম না থাকলেও তাঁদের চিন্তার কারণ নেই। অমিত শাহ স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘নাগরিকত্ব(সংশোধন) বিল ২০২১৬’ আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ও বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দু, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ এবং অন্যদের নাগরিকত্ব (ভারতের) নিশ্চিত করবে। তাই এনআরসির প্রধান নিশানা যে ভারতীয় মুসলমানেরা তা নিয়ে সন্দেহ নেই।

চার. ভারতে এই ধরণের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিকাশ হলে তা উপমহাদেশের সামগ্রিক পরিবেশকে বিষিয়ে তুলতে পারে। বাংলাদেশ এই ভেদনীতির বিষবাস্পে আক্রান্ত হতে পারে। বাংলাদেশের যারা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পৃষ্ঠপোষক তারা এই পদক্ষেপ থেকে বাড়তি সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করতে পারে।

চার.

পৃথিবীর অনেক দেশেই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল নিজের ফায়দা তুলতে এরকম ভেদনীতি, ধর্ম, বর্ণকে ব্যবহার করছে। সর্বত্র তাই এক ধরণের চরমপন্থার উদ্ভব ঘটছে। রাজনৈতিক শিষ্টাচারের বদলে তৈরি হচ্ছে এক বালকসুলভ অর্বাচীন কদর্য রাজনীতির। আবার সেই অর্বাচীনতা নিয়েও চলছে আত্মতুষ্টি। সম্প্রতি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভাষণ দিতে যেয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ‘মাত্র দুই বছর আগে ক্ষমতা গ্রহণের পর আমার প্রশাসন যা অর্জন করেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে আর কোনো প্রশাসন তা পারেনি।’ ট্রাম্পের এই বক্তব্য শুনে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে উপস্থিত রাষ্ট্রনেতাদের কেউ কেউ সশব্দে আবার কেউ কেউ মুখ টিপে হেসেছেন। ট্রাম্প এই হাসিকেও নিজের সাফল্য হিসেবে নিয়েছেন। বলেছেন, তাঁরা আমার সাথে ভাল সময় কাটিয়েছেন।

কাজেই এই অর্বাচীনকালে ‘থ্রি-ডি’র পথ ধরে বাংলাদেশিরা উইপোকা হিসেবে চিহ্নিত হলে অবাক হবার কিছু থাকবে না। কিন্তু বিপদ হচ্ছে এই রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি যে বিপদ আর বিপত্তির সম্ভাবনা তৈরি করবে সেটা সামাল দেয়া সহজ কাজ নয়।

পাঁচ.

লেখাটি শেষ করি পুরাণের ভস্মলোচনের কাহিনী দিয়ে। রাম-লক্ষণ দক্ষিণ সাগরতীরে এসে পৌঁছালো। নানা বিপদ ও বিপত্তি কাটিয়ে তারা ঢুকবে লঙ্কায়। দেখবে সীতার দশা। পথে তারা নানারকম বিপত্তি কাটিয়েছে অনেকের সহায়তায়। শেষে পাশে দাঁড়ালো বিভীষণ। খবর এলো লঙ্কার বাইরে আছে লোহার দেয়াল। ভিতর দিকে রুপোর। সেই লোহার পাচিলে আছে এক মানুষ ঢোকার মতো এক সামান্য ছিদ্র। কিন্তু ছিদ্রপথ আগলে আছে ভস্মলোচন নামের একজন। ভয়ংকর সে। কোনো দিকে তাকায় না। যার দিকে তাকায় সেই ভস্মীভূত হয়। যে লঙ্কায় ঢুকবে তাকেই সে পুড়িয়ে মারবে। এখন তাহলে উপায়? বিভীষণ এগিয়ে এলো। বললো ভস্মলোচন বড় বীর তবে তার বুদ্ধি কম। সবার আগে একটা বড় আয়না দরকার। সেই আয়না সামনে ধরলে যখনই সে তাকাবে তার আগুনে সে-ই ছাই হয়ে যাবে। এরপর সাগরপারের বালিতে তৈরি হলো আয়না। ভস্মলোচনের সামনে সেই আয়না ধরতেই সে ছায়ার মধ্যে নিজেকে দেখতে পেলো। সঙ্গে সঙ্গে সে নিজেই পুড়ে ছাই হয়ে গেলো। দেয়াল পেরিয়ে লঙ্কায় ঢোকার পথে আর কোনো বাধা রইলো না।

পুনশ্চ: রাজনীতির এই ভস্মলোচনদের আজ বড় বাড়ন্ত সময় যাচ্ছে। দরকার এখন মানবিক বুদ্ধির রাজনীতির বিকাশ।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক।

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর