পদ্মা নদীতে পানি কমে যাওয়ায় আবারও কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় অবস্থিত দেশের বৃহত্তম গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) সেচ প্রকল্পের পানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। এ নিয়ে ২৫ দিনের মধ্যে দ্বিতীয় বারের মতো এ প্রকল্পের পানি সরবরাহ বন্ধ হলো।
প্রতিবছর জানুয়ারির মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু হয় জিকে প্রকল্পে পানি সরবরাহ। এ বছরও ১৫ জানুয়ারিতে সেচ পাম্প চালু করা হয়েছে এবং পানি সরবরাহ অব্যাহত ছিল। চালুর পর থেকে পাম্প দুটি ১০ মাস নিরবচ্ছিন্নভাবে চালানোর কথা ছিল। কিন্তু, তা বন্ধ হয়ে যায়। এই প্রকল্পের পানিতে বছরের দুটি মৌসুমে কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরা জেলার এক লাখ ৯৭ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে সেচ কার্যক্রম চলে।
জিকে প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানান, সেচ প্রকল্পটি পদ্মার পানির ওপর নির্ভরশীল। পদ্মায় পানির প্রাপ্যতা সাপেক্ষে প্রকল্পটি চলে। সেখানে পানি কম থাকলে জিকের ইনটেকে পানি প্রবাহ নেমে যাবে এবং তারা পানি সরবরাহ করতে পারবেন না।
জিকে প্রকল্পের হাইড্রোলজি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পানির প্রবাহ গত সোমবার (১৯ এপ্রিল) থেকে কমে যেতে থাকে। আজ বুধবার (২১ এপ্রিল) তা একেবারে কমে গিয়ে দাঁড়ায় মাত্র ২৪ হাজার কিউসেক। কিন্তু, জিকে সেচ চালু রাখতে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে অন্তত ৩৪ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহ প্রয়োজন।
জিকে প্রকল্পের হাইড্রোলজি বিভাগের নির্বাহী কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম বলেন, গঙ্গার পানি চুক্তি অনুযায়ী প্রাপ্য পানি নিশ্চিত করতে প্রতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রতিনিধি দল ফারাক্কা পয়েন্ট ও হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পানির প্রবাহ পর্যবেক্ষণ করে থাকে। এ বছরও জানুয়ারি থেকে দুই দেশের যৌথ পানি পর্যবেক্ষণ শুরু হয়েছে। প্রতি ১০ দিন পরপর পানির পরিমাণ পর্যালোচনা করা হয়।
পাম্প হাউসের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান জানান, রোববার (১৮ এপ্রিল) ভোরে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জিরোতে নেমে আসে দুটি প্রধান পাম্প। আজ বুধবার (২১ এপ্রিল) দুপুর থেকে একইসঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় আরও ১২টি বিভিন্ন ধরনের স্বয়ংক্রিয় সম্পূরক পাম্প। পাম্প হাউসের ইনটেক চ্যানেলে এখন মাত্র চার মিটার আরএল (রিডিউসড লেভেল) পানি পাওয়া যাচ্ছে। পানি সরবরাহ করতে ইনটেকে পানি থাকতে হবে ১৪ দশমিক পাঁচ মিটার আরএল। পানি সরবরাহ চার দশমিক পাঁচ মিটার আরএলের নিচে নামলে পাম্প মেশিনে পানি তোলা যায় না।
কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী রইচ উদ্দিন বলেন, জানুয়ারিতে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে প্রায় ৮০ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহ ছিল, যা চুক্তির চেয়ে ২২ থেকে ২৩ হাজার কিউসেক কম। প্রথম ১০ দিনে ফারাক্কায় ৭০ হাজার কিউসেক বা তার কম পানির প্রবাহ থাকলে বাংলাদেশ ও ভারত উভয়েই ৫০ শতাংশ করে পানি পাবে। দ্বিতীয় ১০ দিনে ফারাক্কা পয়েন্টে ৭০ থেকে ৭৫ হাজার কিউসেক প্রবাহ থাকলে বাংলাদেশ নিশ্চিতভাবে ৩৫ হাজার কিউসেক পানি পাবে এবং অবশিষ্ট পানি পাবে ভারত। তৃতীয় ১০ দিন ফারাক্কা পয়েন্টে ৭৫ হাজার কিউসেক বা তার বেশি পানি প্রবাহ থাকলে ভারত পাবে ৪০ হাজার কিউসেক, বাকিটা পাবে বাংলাদেশ।
জিকে প্রকল্পের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মনিরুজ্জামান বলেন, এই সময়ে বাংলাদেশ ২২ হাজার বা ২৩ হাজার কিউসেকের বেশি পানি পাওয়ার কথা না।
এই কর্মকর্তা আরও জানান, জিকে প্রকল্পের সেচ চালু রাখতে এবার তাদের একটু বেশি হিমশিম খেতে হচ্ছে। কারণ, এবার বৃষ্টি কম। বৃষ্টি হলে নদীতে পানির প্রবাহটা অব্যাহত থাকে। তখন পানি প্রত্যাহার হয়ে গেলেও, পদ্মায় বৃষ্টির নাব্যতা থেকে জিকে পানি টেনে নিতে পারে। কিন্তু, এবার তেমনটি হচ্ছে না।
বাংলাদেশের যৌথ নদী কমিশনের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, ১ জানুয়ারি থেকে ২০ মার্চ পর্যন্ত ফারাক্কায় পানি প্রবাহ ছিল ৫৯ হাজার ৫২২ কিউসেক এবং বাংলাদেশের হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পানির প্রবাহ ছিল ৩৬ হাজার ৩৯৩ কিউসেক। কিন্তু, ২০ মার্চ থেকে শুরু হয় ভারতের হিস্যা। যার ফলে ভারত গঙ্গা থেকে পানি সরিয়ে নেয়, যা শেষ হয় ৩১ মার্চ। ১ এপ্রিল থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশ পানি পায় ৩৫ হাজার কিউসেক। ১১ এপ্রিল থেকে ভারতের হিস্যা শুরু হয়েছে। চলবে ২২ এপ্রিল পর্যন্ত।
উল্লেখ্য, পদ্মা নদীর এই পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রিত হয় ১৯৯৬ সালের ভারত-বাংলাদেশ ঐতিহাসিক গঙ্গা পানি চুক্তির আলোকে। পানি বণ্টন চুক্তি অনুযায়ী প্রতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত শুষ্ক মৌসুমে প্রতি ১০ দিনের হিসাবের ভিত্তিতে ফারাক্কায় পানির প্রবাহ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বণ্টন করা হয়।