‘মঞ্চকুসুম’ শিমূল ইউসুফ, বিক্রমপুরের স্বনামধন্য বাড়িতে জন্ম। বাবা মেহতার বিল্লাহ ছিলেন একজন ব্যবসায়ী এবং সুফিবাদে বিশ্বাসী। সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে ছেলেবেলা থেকেই বেড়ে উঠেছেন। শিমূল ইউসুফ একাধারে একজন অভিনয় শিল্পী, নির্দেশক, কস্টিউম ডিজাইনার ও সংগীত শিল্পী। রেডিও-টেলিভিশনের নিয়মিত শিল্পী হিসেবে দীর্ঘদিন শিল্পাঙ্গনে তাঁর চর্চা অব্যাহত রেখেছেন। শিমূল ইউসুফের জীবনসঙ্গী নাসিরউদ্দীন ইউসুফ একজন মুক্তিযোদ্ধা ও নাট্যব্যক্তিত্ব ও চলচ্চিত্র নির্দেশক।
মুক্তিযুদ্ধে আর্থিক সহযোগিতার জন্য প্রথম আবদুল্লাহ আল মামুনের নাটক দিয়ে নাট্যজগতে শিমূল ইউসুফের পদচারণা শুরু। ঢাকা থিয়েটারে ১৯৭৪ থেকে কাজ করছেন। ‘মুনতাসির ফ্যান্টাসি’, ‘কসাই’, ‘শকুন্তলা’, ‘ফণি মণসা’, ‘কিত্তন খোলা’, ‘কেরামত মঙ্গল’, ‘হাত হদাই’, ‘চাকা’, ‘যৈবতী কন্যার মন’, ‘বন পাংশুল’, ‘বিনোদিনী’ ইত্যাদি তাঁর অভিনীত মঞ্চনাটক।
দেবশ্রী পদক, লোকনাথ পদক, রুদ্র পদক, জাহাঙ্গীর পুরস্কারসহ ২০০৯-এ ‘গেরিলা’ চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ কস্টিউম ডিজাইনার হিসেবে পুরস্কৃত হন। বার্তা২৪.কমের পক্ষ থেকে শিমূল ইউসুফের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিভাগীয় সম্পাদক-নারীশক্তি, ক্যামেলিয়া আলম।
বার্তা২৪: শিমূল আপা, নারীশক্তি বলতে যদি সমাজে তার অবস্থানের ক্ষেত্র বলি, সেই অবস্থানের একজন মানুষ হিসেবে আপনাকে ভাবা যায়। আপনার আজকের এই অবস্থানের পেছনে প্রধানত কার ভূমিকা ছিল?
শিমূল ইউসুফ: আমার পরিবার হয়তো ওইভাবে সলভেন্ট ছিল না, কিন্তু তারা সাংস্কৃতিক দিক থেকে খুব উদার ছিল। আট ভাইবোনের সবার ছোট আমি। আমার বাবা মারা গেছে খুব ছোট বেলায়। যখন আমার চার বছর। কিন্তু বাবার কিছু নির্দেশনা ছিল, সেই নির্দেশনাগুলো আমার মা সারাজীবন পালন করেছেন। আমার মাও খুব দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। আমায় যদি কেউ প্রশ্ন করে আমার জীবনের আদর্শ ব্যক্তিত্ব। তবে অবশ্যই আমি আমার মায়ের কথা বলব। আমি আমার মাকে দেখেই সব শিখেছি। উনার থেকে সাহস, প্রেরণা পেতাম। সবসময়ই উনি আমায় এগিয়ে যাবার কথাগুলো বলতেন। আর বারেবারেই শিক্ষাকে প্রাধান্য দিতেন। বলতেন, লেখাপড়ার পাশাপাশি তোমাকে একজন মানুষ হতে হবে। আর আমার মায়ের একটা আশা ছিল যে, আমরা তিন বোন পাঁচ ভাই, তিন বোনই যেন ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করি। মায়ের বক্তব্য ছিল এরকম, ছেলেরা যা কিছু করে খেতে পারবে, কিন্তু আমার মেয়েরা যেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে সেই শিক্ষাটি যেন ওদের থাকে। তো আমাদের প্রমিজ করিয়েছিল, তোমরা আমাদের কথা দাও তোমরা তিনবোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করবে। মায়ের জীবদ্দশাতেই আমরা তা পালন করতে পেরেছিলাম আর কি।
বার্তা২৪: আপনার মায়ের মেন্টাল স্ট্রেন্থ যা ছিল, তা কি সমাজের কাছে বাধা হয়নি? তৎকালীন সমাজে মেয়েদের শিক্ষার হার খুব কম ছিল, সেই সমাজকে তিনি কী করে মোকাবেলা করেছিলেন?
শিমূল ইউসুফ: মা না এসব ভাবতোই না। আমরা আজকে যে ভাবনাটা ভাবছি বাচ্চাদের জন্য বা ইয়ংদের জন্য। আমাদের সময়ে কিন্তু এই এখনকার মতোন পরিবেশ ছিল না, সত্যি কথা। এই ধরনের সমাজ আমরা দেখিইনি। কাজেই আমার মা নির্দ্বিধায় ছেড়ে দিতেন সব জায়গায়। আমি তো তখন অনেক ছোট। আমার ভাইরা হয়তো সাইকেল করে আমায় রেডিও তে নামিয়ে দিত, রিহার্সেল শেষ হলে আবার সাইকেল করে নিয়ে আসত। আমার মা কোনোদিন রেডিও, টেলিভিশন কোথাও আমাকে নিয়ে যায়নি বা যাবেনই না। বলত, তোমার কাজ তুমি করবে, সেখানে আমি কেন গিয়ে বসে থাকব। এই ধরনের ছিলেন উনি।
বার্তা২৪: কখনো সামাজিক কোনো বাধাই পেতেন না?
শিমূল ইউসুফ: না, না, না, আমরা যে পাড়ায় থাকতাম সে ছিল ঠাকুরপাড়া (বর্তমান সবুজবাগ)। কমলাপুর বৌদ্ধমন্দিরের ওই এরিয়াতে থাকতাম তো। সেখানে থাকতেন জব্বার খান, মুখ ও মুখোশ যিনি করেছিলেন, ওই ফ্যামিলি এরপর সাইফুদ্দীন মামাদের ফ্যামিলি, সাইফুদ্দীন আহমেদ তারপর গাজী মাযহারুল আনোয়ার, জহিরুল হক, পরিচালক ছিলেন চলচ্চিত্রের। আব্দুল আলীম থাকতেন আমাদের পাড়ায়। আমাদের পুরো পরিবেশটাই ছিল সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের। আমরা অন্যভাবে বেড়েই উঠিনি। সংস্কৃতি যেমন সংগীত, নৃত্য ছাড়া কোনোদিন বাঁচা যায়, তা ভাবতেও পারিনি।
বার্তা২৪: আপনার কি মনে হয় আগের চেয়ে সমাজ এখন বেশি রক্ষণশীল?
শিমূল ইউসুফ: এখন তো মানুষ অনেক বেশি রক্ষণশীল। তোমাকে আমি বলি, এই পরিবর্তনটা আমি দেখছি ৯০-এর দশক থেকে। প্রথম প্রথম তখন দেখতাম একটা চাদর গায়ে জড়ানো কালচার। এরপর হাত অবধি ঢাকা চাদর, এরপর ওড়না প্যাঁচানো, এরপর হিজাব। দেখো, আমার মাও গায়ে চাদর জড়াতেন, কিন্তু স্বাভাবিক স্বতস্ফূর্ত এক সামাজিক অবস্থান থেকে। তবে বোরখা হিসেবে নয়। আমি সুফিয়া কামালের কাছে বড় হয়েছি। উনিও ঘোমটা দিতেন, কিন্তু ওই ধরনের কখনো কিছু দেখিনি। আমার কাছ থেকে দেখা তো মা আর সুফিয়া খালা। তারা দাপটের সাথে সমাজে প্রতিষ্ঠিত। সম্ভ্রম রক্ষা করেই চলতেন, কিন্তু রক্ষণশীলতা ছিল না তাতে। আমার মা তো আজীবন ঘোমটা দিতেন, সাদা শাড়ি লাল পাড় এক প্যাঁচ দিয়ে পরতে দেখেছি, কুঁচি দিয়েও পরেননি। আমার বাবা যতদিন বেঁচেও ছিলেন, এই রঙের বাইরে তাকে অন্য রঙের শাড়ি কখনো পরতে দেখিনি। বাবা মারা যাবার পরেও সাদা শাড়ি কালো পাড়। আমি মাকে দেখেছি সাধারণ বেশভূষায়, অথচ রক্ষণশীলতা সেখানে ছিল না।
বার্তা২৪: তারমানে সমাজ আগের চেয়ে বেশি রক্ষণশীল মানসিকতা ধারণ করছে, আবার সেই সাথে বাহ্যিক চাকচিক্যের চেহারাও তো বেড়েছে। এটাকে আপনি কিভাবে দেখেন?
শিমূল ইউসুফ: আমাদের জীবনে বিলাসিতা করা, টাকা নষ্ট করা, এই করা ওই করার মূল্যবোধটাই ছিল না। শিক্ষা আর সুস্থ সংস্কৃতিচর্চার বাইরে আমরা বাহুল্য চাকচিক্যময় জগতই কাটাইনি। যা ছিল আমাদের শিল্পের ভেতরে থাকা, পড়াশোনার ভেতরে থাকা। কিন্তু এই প্রজন্মে সেই শিক্ষা আর শিল্পচর্চার বড়ই অভাব। তারা বেছে নিয়েছে চাকচিক্যময় বহিরাবরণকে। কিন্তু অন্তর্গত মূল শিক্ষা বা সুস্থ সংস্কৃতিচর্চায় তারা অধিকাংশই আর নাই। ফলে সুস্থ শিক্ষার অভাবেই তারা রক্ষণশীল হচ্ছে। ধর্ম মানুষকে ভীত করে দিচ্ছে। দেখো, এই যে ৯০ থেকে বদলানো শুরু হয়ে ২০১০ অবধি সমাজ আমূল পাল্টে গেল। যদি ধর্ম বা এই হিজাবই সমাজ পাল্টে দিত তাহলে কি সমাজে এত ধর্ষণ হতো? আমি তো বলব, বর্তমান সমাজ প্রবৃত্তির দাসে পরিণত।
বার্তা২৪: প্রবৃত্তির এই অধোগমনের পেছনে কিসের ভূমিকা থাকতে পারে বলে আপনার মনে হয়?
শিমূল ইউসুফ: আমি আসলে সঠিক কারণ বলতে পারব না। তবে ফেসবুক একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে বলে আমার মনে হয়। দেখো, আমাদের সময়ে আমরা বন্ধুর সাথেই রেডিও থেকে টেলিভিশনে যাচ্ছি, সেখান থেকে আরেক জায়গায়, কিন্তু আমাদের কাছে বন্ধু মানেই বন্ধু। ছেলে মেয়ে বন্ধু মানেই সাধারণ বন্ধুতাই ছিল। সেখানে কোনো অসভ্যতা ছিল না। আর এই যুগের প্রবৃত্তির সাথে আমাদের যুগের প্রবৃত্তি অনেক আলাদা ছিল। যারা সমাজের কিছু পরিবর্তনে বিশ্বাসী তারা এতটাই বেশি দেখাবার চেষ্টা করছে আবার অন্যদিকে কট্টরপন্থীরা তাদের ক্রমাগত হেয় করার চেষ্টায় আছে, কেমন যেন ডিভিশন হয়ে গেছে সোসাইটিতে। যা আমাদের যুগে ছিলই না। আমরা ছোটবেলায় তা পাইনি। আমাদের ছোট বেলায় আমরা সব উৎসবে সমানভাবে গিয়েছি। কখনো কাউকে আলাদা চোখেই দেখিনি। খুব সূক্ষ্মভাবে আমাদের এখন অসামাজিক করে দেওয়া হয়েছে। ফেসবুক নিয়ে দেখা যায় পরিবারের সবাই যার যার মতো ব্যস্ত। কে সামনে এলো, কে গেল কোনো খবর নাই। অথচ আগে পরিবারে বয়োজ্যেষ্ঠ কেউ সামনে এলে মা শেখাতেন, আগে সালাম দাও। এরপর পানি নিয়ে যাওয়া। এরপর জলখাবারের ব্যবস্থা করা। না খেয়ে বাসা থেকে কেউ বের হতেই পারত না। এ তো আমাদের কালচারে ছিল। আগে দুপুরে কেউ এলে না খেয়ে কেউ যেতে পারত না। এখন তো কেউ বাসায় এলে, কতক্ষণে সে যাবে, তাকে সমাদর করা দূরে থাক, যাবার চিন্তা নিয়ে থাকা হয়। যা আমাদের কালচারে কখনো ছিল না। আমাদের পাড়াতেই তো আমরা মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ একসাথে থাকতাম। ওদের উৎসবে যেমন আমাদের যাওয়া হতো, আবার ঈদ হলে ওরা আসত আমাদের বাড়িতে সেমাই খেতে। এই কমিউনাল চিন্তাই নষ্ট হয়ে গেছে এখন। সবাই আইসোলেটেড।
বার্তা২৪: আপনার প্রথম অভিনীত নাটক কোনটি? আর আপনার নাটকে সবসময়ই নারী মূল অবস্থানে থাকে। আমি উল্লেখ করতে পারি ‘যৈবতী কইন্যার মন’ বা ‘বিনোদিনী’ নাটকের কথা। সাধারণত অধিকাংশ নাটক বা চলচ্চিত্রে দেখা যায় নারী কেবল পার্শ্বচরিত্র, কিন্তু আপনার অভিনীত নাটক তা থেকে ব্যতিক্রম। এটা কি আপনার ইচ্ছাপ্রসূত?
শিমূল ইউসুফ: আমার প্রথম অভিনীত নাটক ‘বিদায় মোনালিসা’, ঢাকা থিয়েটার থেকে আর শেষে করলাম ‘টেমপেস্ট’। আমার নাটকগুলোতে নারী প্রমিনেন্ট হবার পেছনে আমি পারফরমেন্সের কথাই বলব। কখনো পার্শ্বচরিত্র হলেও তাকে আমি এমনভাবে উপস্থাপন করি যে, নারী তখন পার্শ্ব অবস্থান নিয়ে থাকতে পারে না। দর্শক তাকে নিয়ে আলাদা করেই ভাবতে থাকে। আর ঢাকা থিয়েটারের একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় যে, সেখানে অধিকাংশ নাটকই সেলিম আল দীনের। আর সেলিম আল দীন তো সেই লেখক, যিনি অসামান্য জিনিস নিয়ে অসামান্যভাবে তার বর্ননা করে গেছেন। কাজেই আমরা তৈরি হয়েছি ভিন্নভাবে। আর সবচেয়ে বড় কথা, আমি পারফরমেন্সের কথা আবারও বলব। আমরা যখন ‘হাতহদাই’ নাটকটা করলাম, তা ছিল পুরো নোয়াখালির ভাষায়। আমি করতাম ‘ছুকড়ি’ নামের চরিত্র, যা অনেক বড় ছিল আর প্রচুর প্যাচাল ছিল। আমি তার পরিধি কমিয়ে নিয়ে এলাম। আর সেলিম আল দীন স্যারের এক বিশ্বাসের জায়গা ছিল যে, তার নাটক এতে নষ্ট হবে না। ফলে আমি চরিত্রটিকে কমিয়ে মাত্র দুইটি সিকোয়েন্সে এনেছিলাম। আমি ঠিকই করে নিয়েছিলাম যে, আমাকে এভয়েড করতে পারবে না দর্শক। আর তা ঠিকই দর্শকযোগ্যতা পেল। ফলে একটা নাটকে একজন নারী যেই চরিত্রই করে না কেন, তার পরিধি যত ছোটই হোক না কেন, তা যদি সে শক্তিমত্তার সাথে উপস্থাপন করতে পারে, তখন অবশ্যই তা মূল অবস্থানে আসতে বাধ্য। এই চ্যালেঞ্জগুলো আসলে নিতে হয় মেয়েদের। আমাদের জন্য পথ কেউ তৈরি করে দেয় না।
বার্তা২৪: থিয়েটারে এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি নারীর উপস্থিতি চোখে পড়ে, কিন্তু দেখা যায় তারা অধিকাংশই পারফরম্যান্স বেইজড অর্থাৎ অন স্টেইজে তারা যতটা সংখ্যায় ভারী ততটা তারা ব্যাক স্টেজে, যেমন নাট্যকার, সেট ডিজাইনিং, লাইটিং, মিউজিক কম্পোজিশনে না—এর কারণ কী?
শিমূল ইউসুফ: হুম নির্দেশনা ও রাইটার হিসেবে নারী খুবই কম। আসলে নারীরা এখনো এই জায়গাতে দক্ষতা সৃষ্টি করতে পারেনি। সবকিছুই আসলে চর্চার ব্যাপার। নারীরা মেইন স্ট্রিমে এখনো তেমনভাবে আসতে পারেনি। মেয়েদের আসলে এই সেক্টরে প্রচুর কাজ আছে। গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন মেয়েদের এই অভাব পূরণ করতে পারত। কিন্তু তারা কখনো এগিয়ে আসেনি। মেয়েদের জন্য আলাদা প্লাটফর্ম করে তাদের নির্দেশনা, লেখালেখি, ডিজাইনিংয়ে উৎসাহ সৃষ্টি করেনি, দক্ষতা বাড়াতে সহযোগিতা করেনি। ফলে মেয়েদের আগ্রহ অন স্টেজে যত বেশি, ব্যাক স্টেজে ততটা তৈরি হয়নি।
বার্তা২৪: নারী আর পুরুষের সমাজে যে বৈষম্য এখনো আছে তা কেন আছে?
শিমূল ইউসুফ: আমি জোরালোভাবে বলতে পারি, থিয়েটারে নারী পুরুষের বৈষম্য তেমনভাবে পাইনি। যেখানেই গেছি। কিন্তু যদি জেনারেলি দেখি, সেখানে নারী পুরুষের বৈষম্য বিশাল। আগে কোনো পুরুষ যদি পুশ করত, ঘুরেই পিটাতাম। আর রাস্তায় তখন দোকানপাট থেকে লোকেরা এসে সহযোগিতা করত। যা এখন করে না। বরং মনে করে, মেয়েটারই সমস্যা।
বার্তা২৪: এই মানসিকতা পাল্টে কেন গেল?
শিমূল ইউসুফ: অবদমন। পুরুষদের জন্য কোনো রেড এরিয়া নেই। আমাদের সময় তো ছিল। এখন সব এরিয়া থেকে তুলে দৌলতদিয়াই কেবল আছে। এখন মনে করো, একজন পুরুষ মেসে থাকে, তার বউ বাচ্চা সব বাড়িতে থাকে। তার যে কোনো সময় প্রয়োজনে সে কোথায় যাবে, কার কাছে যাবে। তখন সে সামনে যাকে পাবে তাকেই তো বিরক্ত করবে। বাড়ির কাজের লোক থেকে শুরু করে রাস্তা। তাই না?
বার্তা২৪: মানে, মেয়েদের এখনকার হ্যারাসমেন্টের পেছনে এই ইস্যুটি মুখ্য?
শিমূল ইউসুফ: হ্যাঁ, আমি একে এক কারণ মনে করি। যদি কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকত, তাহলে তারা জেনারেলি এই হ্যারাসগুলো করত না। ধর্ষণ করত না। আর মেয়েরা মান সম্মানের ভয়ে অনেকসময় চুপ করে মেনে নিতে বাধ্য হয়। এখন শ্রেণিভেদ নাই, ভারসাম্য নাই সমাজে। যে কোনো পুরুষ যে কোনো নারীর প্রতি সহিংস হয়ে উঠছে। যা আসলে ভয়ের। আর আরেকটা কথা, আমি কিন্তু জীবনে প্রচুর মার মেরেছি। পুরুষের অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছি একদম সবল হয়ে। একবার তো এক পুলিশও মার খেয়েছিল আমার কাছে। দুইঘণ্টার জন্য ওর ব্যাচ আমি নিয়ে এসেছিলাম। আর আমি একাই লড়েছি তখন। আমি মনে করি, আমি যদি এই সমাজেও থাকতাম তবু আমি এই মনোবল রেখে চলতাম। আমি সারভাইভ করেছি এইভাবে। ভয় দেখাতে হবে। আমি এখনো এই শক্তি নিয়ে চলি। আমার ভেতরে যে শক্তি আছে নারীশক্তি, তা নিয়ে চলব। পুতুপুতু করে চলব না। এজন্য মনে করি, মেয়েদের সাহসও তাদের হ্যারাসমেন্ট কমাতে পারে। তবে আমাদের সমাজে মেয়েদের সাহস খুবই কম। এখন যেমন, মেয়েরা চন্দ্রিমা উদ্যানে হিজাব পরে বসেই প্রেম করে। একদিকে ধার্মিক বেশ অন্যদিকে ভিন্ন চেহারা নিয়ে থাকে। আমি তো বলব, মেয়েরা তাদের মেরুদণ্ডই এখন আর রাখতে শেখেনি। ফলে সেও এক কারণ। তবে মায়ের বলিষ্ঠতা একজন মেয়ের মানসিক গঠনের জন্য বিশাল প্রয়োজনীয়। আমি আমার মেয়েকেও এই প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছি। আমার মেয়ে জানে তার মা প্রতিবাদী, তার বাবা মুক্তিযোদ্ধা, ফলে সে সেই মনোবল নিয়ে এই যুগেও ব্যক্তিত্ববান হয়েই কিন্তু চলতে পারছে। এতে অনেক সময় ওর হাতের অনেক কাজ ছুটে যায়, কিন্তু তবু সে অন্যায়ের বিরুদ্ধে তার অবস্থান পাল্টায় না।
বার্তা২৪: মুক্তিযুদ্ধে আপনার ভাই শহীদ হয়েছেন, আপনার স্বামী নাসিরউদ্দীন ইউসুফ একজন মুক্তিযোদ্ধা, আমরা জানি। আমার প্রশ্ন হলো, মুক্তিযুদ্ধে যোদ্ধা পরিচয়ে পুরুষদের পরিচিতি যতটা আমাদের সামনে ফোকাসড হচ্ছে, নারীদের অবস্থানকে তেমনভাবে আমরা দেখি না। তারামন বিবি, সেতারা বেগম, ফোরকান বেগম বা খুব বাড়িয়ে বললে মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের কথা ‘বীরাঙ্গনা’ হিসেবে যতটা আসে ততটা মুক্তিযুদ্ধে পরোক্ষ অবস্থানে থাকা নারীরা কখনো আলোচনায় আসেন না। অথচ যুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে গৃহী সদস্য হিসেবে নারীরা মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু তাদের কোনো মূল্যায়ন নাই।
শিমূল ইউসুফ: হ্যাঁ, আমার মা প্রতিদিন তিনচারজনের ভাত আর ডাল রান্না করে রাখত। যাতে মুক্তিযোদ্ধারা যে কোনো সময়ে এলেই খাওয়া পায়। পরের দিকে আমরা বাজারেও যেতে পারতাম না। তখন খিচুড়ি রান্না করে রাখত। কিন্তু নারীর এই ভূমিকাটা আজীবন অপ্রকাশিত থেকেই গেছে।
বার্তা২৪: মেয়েদের জন্য আপনার শেষ কথা কী?
শিমূল ইউসুফ: মেয়েদের যুগ এখন কোচিং আর বাসার বাইরে তেমন নেই। তাদের সংগঠন করবার স্পেসটাও নাই। আগে পাড়ায় পাড়ায় লাইব্রেরি থাকত, তখন মায়ের জন্য প্রতি সপ্তাহে বই নিয়ে আসতাম। এখন সংগঠন নাই, কোথাও খেলার মাঠ নাই, পড়ার পরিবেশ নেই। ফলে তাদের জীবন অনেক বেশি জটিল। তবু আমি বলব, শিক্ষা অর্জনের কথা । শিক্ষা আর শিল্পচর্চার বিকল্প পথ নাই। মেয়েদের সেই জায়গাটুকু নিয়ে ভাববার প্রয়োজন।