নুরুন নাহার বেগম একশন এইড বাংলাদেশে সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার হিসেবে কর্মরত। জেন্ডার সহিংসতা নিয়ে কাজ করছেন দীর্ঘদিন। তিনি নিজেও এসিড সন্ত্রাসের শিকার। পরিবার, সমাজের মানসিক নিপীড়নের মুখেও অদম্য মনোবল নিয়ে কাজ করে ক্ষমতার শীর্ষে নিজের অবস্থান চূড়ান্ত করেছেন।
আমি একবার পেছন ফিরে তাকাই, দুই পা সামনে বাড়াই। ফিরে যাই সেই আমার ছোট বেলার দুরন্তপনায় যা কখনো মা আর ভাই ছাড়া কেউ মেনে নিতে পারেনি। এক অজপাড়া গাঁয়ে আমার বেড়ে ওঠা। বাবা বেঁচেছিলেন আমার বয়স দশ বছর পর্যন্ত, তখনও খুব ভালো করে বুঝতে পারতাম না ছেলে মেয়ের ভেদাভেদ। সাত আট বছর পর্যন্ত প্রায় ছেলেদের পোশাক পরেছি। বাবার সাথে বাজারে যেতাম, মাঠে খাবার নিয়ে যেতাম। পাড়া প্রতিবেশি বাবাকে কটাক্ষ করে বাবার নাম ধরে বলতেন ওমকে তার ছেলেকে নিয়ে বাজারে আসছে, বাবা তাতে কখনোই কর্ণপাত করতেন না। বাবা যখন মারা গেলেন আমি তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি।
আমার প্রথম ধাক্কা আমার মা যখন আমাকে হাইস্কুলে ভর্তি করালো। আমার পাড়া প্রতিবেশি এবং চোদ্দগোষ্টী সবাই আমার অভিভাবক। মেয়েকে হাইস্কুলে পড়ানোর কী দরকার? একটু বলে রাখি তখন আমার বাড়ির মধ্যে আমি প্রথম মেয়ে যে হাইস্কুলের বারান্দা পর্যন্ত পৌঁছেছি। আজ মায়ের কাছে এই সমালোচনা তো কাল সেই সমালোচনা যেমন, আমি রাস্তায় কারো সাথে কথা বললাম, কাকে দেখে দাঁড়ালাম, কার সাথে স্কুলে গেলাম ইত্যাদি। মা এক কান দিয়ে শোনে তো অন্য কান দিয়ে বের করে দেয়। হয়তো গ্রামে যারা বড় হয়েছেন তারা কিছুটা তাদরে জীবনের সাথে মেলাতে পারছেন। তখন অমার চারপাশের লোকজন যেন আমার কাছে একটি ভয়ের বস্তু। কোনো মানুষ দেখলেই ভয়ে থাকতাম মায়ের কাছে কী না কী নালিশ করে। সেই ছোটবেলা চঞ্চল মেয়েটি একটি নিরীহ প্রাণীতে রূপ নিল। আমার মাও যেন, আমার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, মেয়েকে এসএসসি পাস করাবেনই।
অন্যায় আমার সাথে। সমাজ ও পরিবার আঙ্গুলও তোলে আমার দিকে এবং তাদের কাছে যে অপরাধী—সেও আমি। নারীদের তো চলার পথে অনেক বাঁধা, অনেক কাঁটা, আরো আমি হলাম নির্যাতনের শিকার নারী, খারাপ নারী তো বটেই, আরো যা যা খারাপ শিরোনাম আছে সব আমার নামের সাথে সংযোগ না করতে পারলে সমাজের মানুষের পেটের ভাত যেন হজমই হয় না।
আমি যখন চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালে ছিলাম তখন আমার মা, ভাই বলত শুধু তোমাকে আমরা জীবিত দেখতে চাই আর কিছু দরকার নাই, কিন্তু সুস্থ হয়ে যখন বাড়ি গেলাম সমাজ আত্মীয় স্বজন অনেকেই আমাকে নিয়ে চিন্তিত, কারণ আমাকে দিয়ে কী হবে? প্রথম কথা, যেহেতু আমার চেহারা সুরত নাই আমাকে বিয়ে দেয়া যাবে না। জীবনটাই শেষ, যেহেতু আমাকে দিয়ে কিছু হবে না ঘরে বসে আর কতদিন মা খাওয়াবে। পাশের ঘরের এক ভাবি তো আমার সামনেই মাকে একদিন বলে ফেললেন ঘরে যে একটা রেখেছেন এটা দিয়ে কী করবেন, কী হবে? মা বলল, এটা তো আমার চিন্তা তোমার সমস্যা কোথায়। সামাজিক এবং মানসিকভাবে হেনস্থা হওয়া একজন মানুষকে কতটা পেছনে ফেলে দিতে পারে তা আমি ভালো করে জানি। সমাজের কাছে নারী মানেই সুন্দরী হতে হবে, বিয়ে করতে হবে, বাচ্চা পয়দা করতে হবে। যাই হোক, অনেক চরাই উৎরাই পার করে বর্তমানে একটি জায়গায় এসেছি কিন্তু সমাজের আত্মীয়দের ঘ্যানঘ্যান আর পিছু ছাড়ছে না। আমি মনে করি প্রতিটি মানুষের ভালো থাকা নির্ভর করে তার নিজের ওপরে, আমি যদি বিয়ে না করে ভালো থাকতে পারি, বাচ্চা পয়দা না করে ভালো থাকতে পারি তাহলে আপনাদের এত মাথা ব্যাথা কেন?
একটি মানুষের চলার পথে যদি এত কাঁটা থাকে তাহলে সে এগোবে কী করে, তবে যদি কেউ সব কাঁটাকে উপেক্ষা করে এগিয়ে যেতে পারে সে জীবনে সফল হবেই এটা আমি নিশ্চিত। বর্তমানে কাজ করছি লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা বন্ধে। পাড়ি দিতে হয় দেশের এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত। একটা সময় ভাবতাম এই সমস্যা বোধহয় আমার সমাজে, কিন্তু না, এ তো আমার একার এলাকার সমস্যা না, পুরো দেশটাই একই রকম।
তাই নারীদেরকে বলছি এগিয়ে যাও অতিক্রম করো সকল বাঁধা। মানুষ তোমাকে খারাপ বলবে বলুক তাতে তোমার কী আসে যায়। নিজেকে ভালোবাসো, নিজের ভালো থাকাটাকে গুরুত্ব দাও। হও তুমি তোমার মতো, তোমাকে নিয়ে কি কেউ ভাবছে? তাহলে তুমি কেন মানুষকে নিয়ে এত ভাবছো। তুমি যদি তোমার মনের কথা শোনো সফলতা তোমার আসবেই।