বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। মাথায় সংসারের হাজারো চিন্তা, চোখে ক্লান্তি। সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনির পর ক’পয়সা মজুরির অপেক্ষা করছেন মায়া বেগম। কাছে গিয়ে জানতে চাইলে খানিকটা অভিযোগ ঝড়ে পড়লো তার কণ্ঠে। বললেন, ‘সারাদিন সমান তালে (পুরুষ কর্মীদের সাথে) কাজ করলাম মজুরির বেলায় আমগোরে শেষে ফালাইলো। সব জায়গায় আমগোর (নারীদের) কষ্ট।’
২০ বছর আগে কোনো কারণ ছাড়ায় স্বামী ত্যাগ করে মায়াকে। শুরু হলো দুই সন্তান নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই। তারপর থেকেই সংসার নামক জীবনের ঘানি টানতে হচ্ছে তাকে। আজ ষাট বছর পার করেও মুক্তি পায়নি সংগ্রামী এই নারী।
দুই সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে ঢাকায় পাড়ি জমান তিনি। শুরু হয় জীবনের নতুন অধ্যায়। দিন যায় সে অধ্যায়ে যোগ হতে থাকে নতুন নতুন কষ্টের গল্প। পাথর ভেঙে কত টাকা আয় হয় জানতে চাইলে ফ্যাকাশে মুখ করে তিনি জানান, ৪৫০ টাকা। কিন্তু এই একই কাজের জন্য তার পুরুষ সহকর্মীটি পান ৫০০ টাকা। শুধু নারী বলেই তাকে ৫০ টাকা কম দেওয়া হয়। শুধু তাই নয় মাঝে মাঝে মজুরি পেতেও সমস্যা হয়। অনেক সময় বাকি থাকে। আবার কাজ না পেলে সংসারে নেমে আসে অন্ধকার। তখন থাকতে হয় আধ পেটে।
বার্তা২৪.কমের এর কাছে মায়া বেগম তার সংসার চালানোর গল্পটার ইতি টানেন দীর্ঘশ্বাস দিয়ে। চাপা অভিযোগের সুরে বলেন, হয়তো পুরুষ বলেই তারা সব সময় উপরেই থাকে। সবাই কয় আমাদের চেয়ে পুরুষরা বেশি কাজ করে। আপনারা লেইখা কি করবেন এতো কাল গেল কত্ত যে কষ্ট করছি কেউ তো কোনোদিন এক পয়সা দিয়ে সাহায্য করেনি। গরিবের কষ্ট ছাড়া জীবনে আর কি আছে।
শুক্রবার গভীর রাত। যখন কিনা নারী দিবস নিয়ে চলছে আয়োজনের তোড়জোড়। ঠিক সে সময় শাহবাগের রাস্তায় পিচ ঢালাইয়ের কাজ করছিলেন কুলসুম আক্তার। মাথায় পাথর বয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। তার মতো আরও কয়েকজন নারী কাজ করছেন সেখানে। কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়লেও দায়িত্ব তাকে বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছিল থামলে চলবে না। এত রাতভর কাজ করছেন কেন জানতে চাইলে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে কুলসুম বললেন, ‘পেট চালাতে গিয়া রাত-বিরাত দেখলে কি হইবো আমগোর?’
তার মুখে শোনা গেলো আরেক কষ্টের গল্প। তিনি বলেন, স্বামী তাকে ছেড়ে অন্যত্র বিয়ে করেছেন আরও ১৫-১৬ বছর আগে। এরপর থেকে ৪ সন্তানের দেখভালের দায়িত্ব তিনিই পালন করেছেন। দুই ছেলের বড়টা চাকরি করছে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে। ছোটটা এখনো পড়ালেখা করে। মেয়ে দুটিকে বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেরা চাকরি নেওয়ার পর কিছুদিন সুখের মুখ দেখলেও ছেলে বিয়ে করার পর সেই সুখ আবারও হারিয়ে যায়। কিন্তু থেমে থাকেননি কুলসুম। আবারও নেমে পড়েছেন জীবন যুদ্ধে। কথাগুলো বলতে বলতে চোখের পানি মুছছিলেন কুলসুম। পানি মুছতে মুছতে বললেন, ‘পোলাপানরে মানুষ করছি নিজের সুখের জন্য না। দায়িত্ব থেকে। ছোটটাও যদি আমারে কোনোদিন না জিগায় তাতে কষ্ট লাগবে না। ওরা সুখে থাকতে পারলেই আমার সুখ।’
শুধু এই দুই নারীই নয় এমন হাজারও মায়া আর কুলসুম বাস করে আমাদের চারপাশে। দেখার মতো করে দেখলে এমন হাজারও অসংগতি চোখে পড়বে আমাদের। শুধু মেয়ে বলেই সরকার ঘোষিত সমঅধিকার থেকেও বঞ্চিত তারা।
অথচ কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’
কিন্তু সমাজের এসব নারীরা পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। শুধু দিনে নয় গভীর রাতেও পেশির শক্তি ব্যয় করে এসব দরিদ্র নারীরা কাজ করছে দু’বেলা দু মুঠো আহার মুখে তোলার জন্য। পরিবার নিয়ে একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই পাবার আশায়। কিন্তু প্রাপ্তির বৈষম্যের শিকার হন সেই সব নারী। তাদের গল্প খুব বেশি সামনে আসে না। সামনে এলেও হয়তো কালের গহ্বরে আবার তা হারিয়ে যায়।
নানা পথ বেয়ে ১৯১৪ সাল থেকে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়। বছরের কেবল এই দিনটাই নিপীড়িত ও সুবিধা বঞ্চিত নারীদের কথা ফলাও করে প্রচার করা হয়। কিন্তু তাতে কি খুব বেশি সুবিধা করতে পেরেছে তারা?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন এখনো সমতা তৈরি হয়নি। সমতা প্রতিষ্ঠা করতে হলে সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবার সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
এ বিষয়ে গ্লোবাল ক্যাম্পেইন ফর এডুকেশনের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর রাশেদা কে. চৌধুরী বলেন, নারী দিবস তো পৃথিবীর সবখানেই ঘটা করেই পালিত হয়। কিন্তু এটার একটা তাৎপর্য থাকতে হবে কেবল স্লোগান বা থিমের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়। এর প্রতিপাদ্য থাকে, স্লোগান থাকে, ঘটা করে পালিত হয় কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে খুব স্বাভাবিকভাবে একটি প্রশ্ন এসে যায় আসলেই কি একটি দিন (নারী দিবস) নাকি সব দিনই নারী-পুরুষের সমতা হওয়া উচিত! এমনো প্রশ্ন আসে আলাদা করে নারীর কথাই বলতে হবে কেন? প্রশ্নটা ওখানেই যে নারীরা অনেক এগিয়ে গিয়েছে কিন্তু সমতা এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
তিনি আরও বলেন, কর্মক্ষেত্রের কথা যদি বলি এখন নারীদের জন্য নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। নারীরা সুযোগ পেলে ভালোও করছে কিন্তু তাদের প্রতিবন্ধকতা তো পদে পদে। আমরা বারবার বলছি ক্রীড়াঙ্গনে নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পুরুষ ক্রিকেট দল আর নারী ক্রিকেট দলের কথা যদি বলি এখানে বৈষম্য আছে।
নারী-পুরুষের সমতা তৈরি করতে করণীয় কী এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বৈষম্য কিন্তু শুধু আমাদের দেশে না বিশ্বজুড়েই নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য আছে। কিন্তু যেকোনো মূল্যে রাষ্ট্রীয়ভাবে নারীর মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে এটা আমাদের সংবিধানেই আছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো তারপরও নারী কেন এত নির্যাতিত হয়? কেন মাধ্যমিকে নারীরা এত ভালো ফলাফল করার পরও মাঝপথে এসে ঝরে যায়, কেন বাল্য বিয়ের শিকার হয়? নারীর প্রতি সহিংসতার লাগাম তো কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না। তাই ঘরে-বাইরে সবখানেই এই সমতার মন-মানসিকতা আসতে হবে। রাষ্ট্রপতি, পরিবার, সমাজ সবাইকেই এর ভার নিতে হবে।
বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাস্ট্রিজ এর সভাপতি সেলিমা আহমাদ বলেন, আমরা যতই বলি না কেন নারীরা স্বাধীন হয়েছে, নারী-পুরুষের কাজে সমতা তৈরি হয়েছে কিন্তু আসলে দেখতে গেলে এখনও তেমন কিছুই হয়নি। বর্তমান সরকার নারীবান্ধব সরকার নারীদের জন্য অনেক সুযোগ-সুবিধা তৈরি করেছে। কিন্তু তারপরও নারীরা এখনও অনেক ক্ষেত্রে বঞ্চিত হচ্ছে।