একজন মানুষের জন্য সারা বিশ্ব তাকিয়ে ছিল নিউজিল্যান্ডে নির্বাচনের দিকে। তিনি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং লেবার পার্টির প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী জেসিন্ডা আরডার্ন। বিশ্ববাসীর প্রত্যাশা পূর্ণ করে বিজয়ী হয়েছেন তিনি। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দূত এই নেত্রী বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস মোকাবিলায়ও ছিলেন দারুণ সফল। শনিবারের (১৭ অক্টোরব) ভোটে দ্বিতীয়বারের মতো নেতৃত্বের আসনে অভিষিক্ত হলেন তিনি মানুষের ভালোবাসা, আস্থা ও সমর্থনে সিক্ত হয়ে।
পুরো নাম জেসিন্ডা কেটি লওয়েরেল আরডার্ন। জন্ম ১৯৮০ সালের ২৬ জুলাই। এশিয়া-প্যাসিফিকের গুরুত্বপূর্ণ দেশ নিউজিল্যান্ডের রাজনৈতিক ক্ষমতায় এসেই সবার নজর কাড়েন এই তরুণ নেত্রী। ১৮৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন পার্লামেন্টে নবীন জেসিন্ডাকে স্থান দিয়ে দেশবাসী যে মোটেও ভুল করেনি, পদে পদে সে প্রমাণ রেখেছেন তিনি। দেশবাসীর সুখে-দুঃখে একান্তভাবে মিশে গেছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী নয়, বাড়ির মেয়ের মতো পাশে থেকে কাজ করেছেন জনতার সাথে।
ফলে শনিবারের (১৭ অক্টোবর) নির্বাচনে তিনি যে আবার নির্বাচিত হয়ে দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হবেন, তা নিউজিল্যান্ডবাসীর মতো সারা বিশ্বের মানুষও নিশ্চিত ছিলেন। কারণ তার তৎপরতা, মানবিকতা, পরমত সহিষ্ণুতা, সঙ্কটে দৃঢ়তা ও সততা-স্বচ্ছতা দেশবাসীর মতো বিশ্ববাসীরও অকুণ্ঠ প্রশংসা পেয়েছিল।
নিউজিল্যান্ডের জাতীয় নির্বাচনে সকাল থেকেই ভোটকেন্দ্রে ভিড় লক্ষ্য করা গিয়েছিল এবার। নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্ন বিজয়ী হবেন তা জনমত নিশ্চিত করে আগেই। তবে একটি মৃদ্যু সংশয়ও ছিল, তিনি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবেন কিনা, তা নিয়ে।
সব সন্দেহের অবসান ঘটিয়ে নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন। দুই তৃতীয়াংশ ভোট গণনাকালেই তিনি ৪৯ দশমিক দুই শতাংশ ভোট পেয়েছে। তার নেতৃত্বে লেবার পার্টি পার্লামেন্টের ১২০ আসনের মধ্যে ৬৪টিতে জয়ের স্পষ্ট আভাস পেয়ে ক্ষমতার পথে সুনিশ্চিত যাত্রা করেছে।
নিউজিল্যান্ডে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল সেপ্টেম্বরে। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারির কারণে এক মাস পিছিয়ে দেয়া হয় তা। তারপর শনিবার সেখানে ভোট হয়। স্থানীয় সময় সকাল ৯টায় ভোটকেন্দ্র খুলে দেয়া হয়। ভোটগ্রহণ চলে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত। তবে আগাম ভোটগ্রহণ শুরু হয়েছে ৩রা অক্টোবর থেকে। ফলে এরই মধ্যে ১০ লক্ষাধিক ভোটার তাদের ভোট দিয়েছেন আর জেসিন্ডার জয়ের রেখা তাতেই স্পষ্ট হয়।
বলে রাখা ভালো, ১৯৯৬ সালে নিউজিল্যান্ডে সংসদীয় পদ্ধতি বলে পরিচিত ‘মিক্স মেম্বার প্রোপোরশনাল’ (এমএমপি) পদ্ধতি চালু হয়। তখন থেকে এখন পর্যন্ত কোনো একক পার্টি নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। তবে জাসিন্ডা দ্বিতীয় মেয়াদেও বিজয়ী হবেন একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েই, এমন তথ্যই প্রকাশিত হয় একাধিক জনমত জরিপে।
জরিপগুলোতে প্রাপ্ত মতামতে দেখা যায়, মানুষের পূর্ণ আস্থা রয়েছে জেসিন্ডার প্রতি। কারণ তিনি করোনাভাইরাস মহামারি সফলতার সঙ্গে মোকাবিলা করেছেন। এ ছাড়া তিনি ক্রাইস্ট চার্চে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, তার জন্য বিশ্বজুড়ে খ্যাতি পেয়েছেন। তখন তিনি ধর্ম বর্ণ সব ভুলে মানবতার নেত্রী হিসেবে মুসলিমদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন এবং সন্ত্রাসকে সম্মিলিতভাবে ও সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। একজন আদর্শ নেত্রীর মতো শান্তনা দিয়ে তিনি মুসলিমদের প্রতি পাশ্চাত্যের বিরূপ সমালোচনা ও বিষোদাগারের জবাব দিয়েছিলেন। অস্ত্র বহণ নিষিদ্ধ ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত পদক্ষেপ নিয়ে বিশ্বব্যাপী সম্মান অর্জন করেছিলেন তিনি।
জেসিন্ডার কাজের মূল্যায়নে জনগণ তাকে পূর্ণ সমর্থনের পাশাপাশি তার প্রতিদ্বন্দ্বী রক্ষণশীল ন্যাশনাল পার্টির নেতা জুডিথ কলিন্সকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। জুডিথ কলিন্স এরই মধ্যে নির্বাচনের ফল মেনে নিয়েছেন। তিনি ‘ঐতিহাসিক ও অভূতপূর্ব’ বিজয়ের জন্য বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হওয়ায় অভিনন্দন জানিয়েছেন। বিশ্ব মিডিয়াও মন্তব্য করেছে যে, জেসিন্ডার দল যদি নির্বাচনের ফলাফলে এই ধারায় এগিয়ে থাকে তবে তা ১৯৯৬ সালের পর থেকে নিউজিল্যান্ডের বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিজয় হবে।
যদিও এখনো ফলাফল গণনা করা হচ্ছে। বিদেশে বসবাসরত নিউজিল্যান্ডের নাগরিকদের থেকে ভোটগ্রহণ শেষে আগামী ৩ সপ্তাহের মধ্যে নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করা হবে, তথাপি জেসিন্ডাকে বিজয়ী ঘোষণার বিষয়টি কেবল আনুষ্ঠানিকতা বলেই বিবেচিত হবে। মানুষের ভালোবাসা, আস্থা, সমর্থনে সিক্ত জেসিন্ডা আরডার্ন শুধু তার দেশেই নন, সারা বিশ্বের মানুষের মন জয় করেছেন অনুপম নেতৃত্বের গুণে, মানবিক ব্যক্তিত্বে ও জনকল্যাণধর্মী রাজনীতির আবহে। বিশ্ব রাজনৈতিক নেতৃত্বে নারীশক্তির বিকশিত আলোকমালার অন্য নামে পরিণত হয়েছেন জেসিন্ডা আরডার্ন।