ঢাকা: দুনিয়া জুড়ে এখন সবচেয়ে বড় আতঙ্কের নাম ফেইক নিউজ বা ভুয়া সংবাদ ছড়ানো। গণমাধ্যমের প্রকৃতি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ফেইক নিউজের প্রকৃতিও পরিবর্তিত হয়েছে। এখন শুধুমাত্র সংবাদ মাধ্যম নয় বরং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ফেসবুক, টুইটার বা ইউটিউবের মাধ্যমেও মিথ্যা সংবাদ ছড়িয়ে পড়ছে।
গত রোববার থেকে রাজধানীজুড়ে সহপাঠী হত্যার বিচার চেয়ে স্কুল শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের দাবিতে চলমান আন্দোলনের প্রভাব পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও। ছবি এডিট করে শিক্ষার্থীদের হাতে সাজানো প্ল্যাকার্ড ধরিয়ে বিতর্ক তৈরি করা, পুলিশ, রাজনীতিবদসহ অন্যান্য পেশার মানুষকে ব্যাঙ্গ করার ভিডিও ও ছবি ফেইসবুকে প্রকাশ করা, সর্বশেষ আন্দোলনের সপ্তম দিনে ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হত্যা, ধর্ষণের মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়েও গুজব ছড়ানো হয় ফেসবুকে। সব মতাদর্শের লোকেরা নিজেদের মতের সঙ্গে মিলে এমন সব পোস্ট ফেসবুকে ছড়িয়ে দিতে থাকেন। ফেসবুক ব্যবহারকারীদের একটি বড় অংশ এক্ষেত্রে দ্বিধায় পড়ে যান বা কনফিউজড হন।
অনেককেই দেখা যায় মিথ্যা জেনেও শুধুমাত্র নিজের মতাদর্শ প্রচার করতে বা বিরুদ্ধ মতকে বিতর্কিত করতে ফেইক নিউজ বা ভুয়া পোস্ট নিজেরা তৈরি করছেন বা শেয়ার দিয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ক্ষেত্রে যেকোনো সংবাদ বা তথ্যকে যাচাই বাছাই ছাড়া বিশ্বাস করা যাবে না। সেক্ষেত্রে কয়েকটি মূলধারার গণমাধ্যম থেকে সংবাদটি যাচাই করতে হবে। তবে মানুষ কেন এই ফেইক নিউজ বা ভুয়া পোস্ট এতো বেশি বিশ্বাস করছেন, সেটির কারণও খতিয়ে দেখা দরকার।
২০১৬ সালে আমেরিকায় সাধারণ নির্বাচনের পর থেকে দুনিয়াজুড়ে আলোচিত হয়ে ওঠে ফেইক নিউজ টার্ম বা শব্দটি। যেখানে পরে আবিষ্কৃত হয় রাশিয়ার পাশের একটি ছোট দেশ মেসিডোনিয়া থেকে কয়েক হাজার ওয়েবসাইট শুধুমাত্র নির্বাচনকে কেন্দ্র করে চালু হয়েছিল। ফেইক নিউজ পরিবেশনের মাধ্যমে যেমন তারা আমেরিকার নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছিল তেমনি নিজেরা অর্থও আয় করেছিল। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, মূলধারার গণমাধ্যম জনগণ থেকে বিচ্যুত হয়ে যাওয়াতে ফেইক নিউজ বা ভুয়া খবর এতো বেশি জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
ফেসবুকের মিথ্যা খবরের ওপর একটি গবেষণা চালিয়েছেন সিঙ্গাপুরের নানিয়াং টেকনোলজি ইউনিভার্সিটির উই কিম উই স্কুল অব কমিউনিকেশন অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এডসন সি টানডর জুনিয়র। ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে সিঙ্গাপুরের দুই হাজার ৫০১ জন ফেসবুক ব্যবহারকারীর ওপর জরিপ চালান তিনি। জরিপের গবেষণাপত্রে তিনি উল্লেখ করেন, দেখা গেছে মানুষ ভুল সংবাদ তখনই বিশ্বাস করে যখন আগে থেকেই সেই বিশ্বাস মানুষ মনে মনে লালন করে থাকেন। সিঙ্গাপুরে ২২ দশমিক ৪০ শতাংশ মানুষ ফেসবুকের ফেইক নিউজ বিশ্বাস করেন, ১২ দশমিক ২৫ শতাংশ লোক এসব মিথ্যা পোস্ট সরাতে ফেসবুকে রিপোর্ট করেন, যারা বা যেসব একাউন্ট এই ধরনের মিথ্যা সংবাদ ও ভুয়া ছবি পোস্ট করেন তাদেরকে ব্লক করে দেন ১২ দশমিক ৩ শতাংশ লোক, ১২ দশমিক ১ শতাংশ লোক ওই সব পোস্টকে মিথ্যা জানিয়ে কমেন্ট করেন, ১১ দশমিক ৪ শতাংশ লোক ভুয়া খবর পোস্ট করা ব্যাক্তিকে ম্যাসেজ পাঠান এবং মাত্র ৬ দশমিক ৫ শতাংশ লোক এই সব ভুয়া খবরকে সংশোধন করে নিজের ফেসবুক ওয়ালে পোস্ট করেন।
তিনি গবেষণাপত্রে আরও উল্লেখ করেন, কোনোভাবেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মিথ্যা খবর বন্ধ করা যাবে না। কারণ সবাই যে এক দেশ থেকে এইসব ফেইক নিউজ পোস্ট করেন তা নয়। বরং বিদেশে বসেও অনেকে ফেইক নিউজ পোস্ট করতে পারেন।
এ সমস্যার সমাধান হিসেবে জনগনকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়ে এডসন বলেন, মিথ্যা খবর বিশ্বাসের সঙ্গে শিক্ষার বিষয়টিও জড়িত। তবে মানুষ কী বিশ্বাস করে এবং কী পোস্ট করা হয়েছে সেটি এখানে বড় বিষয়। যদি মানুষ আগে থেকেই একটি ধারণায় বিশ্বাস করেন এবং তার মতের সঙ্গে মিল আছে এমন ভুয়া কোনো পোস্টও দেখেন, তিনি সেটি বিশ্বাস করেন।
আমেরিকার ডার্টমাউথ কলেজের ডিপার্টমেন্ট অব গর্ভনমেন্টের অধ্যাপক ব্রেন্ডান নিহান তার এক গবেষণা দেখিয়েছেন, শুধু মানুষ যা বিশ্বাস করে তাই নয় বরং যেরকমটা তিনি দেখতে চান সেই রকম ফেইক নিউজও বিশ্বাস করেন। এমনকি মানুষ সত্যটা জেনেও ফেইক নিউজ বা তার মনের মতো সংবাদ ও পোস্টকে ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করেন।
তিনি এক জরিপে দেখতে পান, বারাক ওবামা আমেরিকান নন, এই ধরনের একটি গুজব ৪২ শতাংশ রিপাবলিকান বিশ্বাস করেন। যেটা মাত্র ১৫ শতাংশ ডেমোক্রেট সমর্থকরা বিশ্বাস করেন। এই ধরনের ফলের কারণ হিসেবে তিনি বলেন, রিপাবলিকানরা রাজনৈতিক মতাদর্শের দিক থেকে ইতোমধ্যে ওবামা বিরোধী অবস্থানে রয়েছে, সেক্ষেত্রে যদি এই ধরনের একটি গুজব শুনে সেটি সহজেই বিশ্বাস করবে।
দ্যা ইনফ্লুয়েনশিয়াল বইয়ের লেখক নিউরোসায়েন্টিস্ট টালি সারট এই বিশ্বাসকে 'কনফারমেশন বায়াস' হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, মানুষের আবেগ, যুক্তি এবং অতীতের ঘটনার সঙ্গে যদি কোনো ফেইক নিউজ বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পোস্ট মিলে যায়, তাহলেই সে ওই খবর বিশ্বাস করে। এই ধরনের খবর যখন মাথায় প্রবেশ করে আর নিজের বিশ্বাসকে সমর্থন করে তখনই নিউরনে সেটি এক ধারায় চলে আসে আর মানুষ সেটিকে প্রচার করতে থাকে বা আনন্দ অথবা দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
তিনি আরও বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু দেখেই গুজব ছড়ানো যাবে না। বরং ধৈর্য ধরে তথ্যটি নিশ্চিত হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করতে হবে।