সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বহুমাত্রিক সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়ছে। এটা বৈশ্বিক সমস্যা। হরহামেশা দেশে দেশে এ নিয়ে হইচই বেধেই থাকে। এ নিয়ে সরকার আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর যুক্তিতর্কও হয়ে ওঠে বৈশ্বিক। এমনই আলোচনায় সরব হয়েছে ভারত।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়ছে বলে মন্তব্য করেছেন ভারতের অ্যাটর্নি জেনারেল কে কে বেণু গোপাল। এ প্রসঙ্গে জাতীয় স্বার্থে সুপ্রিম কোর্ট ভারতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের সন্ত্রাসী কাজের অনুসন্ধানের জন্য স্যোশাল অ্যাকাউন্টগুলোর সাথে ভারতের আধার কার্ডকে (ভারতের রাষ্ট্রীয় পরিচয়পত্র) সংযুক্ত করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুতারোপ করেছে।
বিচারপতি দীপক গুপ্তের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে জ্যেষ্ঠ আইনি কর্মকর্তা বলেছেন, সাইবার অপরাধে জোর দেওয়া, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে স্যোশাল মিডিয়ার ব্যবহার, গুজব সন্ত্রাস, সহিংসতা, অশ্লীলতা প্ররোচনা- এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও শনাক্তে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর জন্য অভিযুক্ত অ্যাকাউন্ট ব্যবহারকারীদের সব ধরনের তথ্য জানা প্রয়োজন।
তামিলনাড়ুতে ব্লু হোয়েল গেমের ক্ষতিকারক প্রভাবের প্রসঙ্গ তুলে বেণুগোপাল বলেন, স্যোশাল মিডিয়ার বিপদগুলোর মধ্যে ‘ব্লু হোয়েল’ গেম অন্যতম। এই গেমের কারণে অনেক প্রাণহানি হয়েছে। এখনও জানি না যে, এই গেমটির উদ্ভব কী উদ্দেশে হয়েছিল। এ ধরনের গেমের পেছনের মানুষগুলো কেন এমন গেম ছড়িয়ে দিয়েছে।
সামাজিক মিডিয়ায় আধার কার্ডের সংযোগ সম্পর্কিত বিভিন্ন আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সোশ্যাল মিডিয়া জায়ান্ট ফেসবুক এবং তার মালিকাধীন হোয়াটস অ্যাপের বিরুদ্ধে মামলা চলমান আছে বোম্বে, ওড়িশা ও মাদ্রাজের হাইকোর্টে।
এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে ফেসবুক এবং হোয়াটসঅ্যাপের পক্ষে উপস্থিত জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মুকুল রোহাতগি এবং কপিল সিবাল যুক্তি দিয়েছিলেন, সুপ্রিম কোর্টের উচিত এ ধরনের আবেদন নিজের দায়িত্বে না নেওয়া। এটি একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। যেহেতু বিষয়টি একটি নীতিগত বিষয়। তাই কেন্দ্রীয় সরকারের সুস্পষ্ট মতামত না নিয়ে উচ্চ আদালতের এ ধরনের হস্তক্ষেপ করা অনুচিত।
ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার বিষয়টি খতিয়ে দেখছে। মাদ্রাজ হাইকোর্টের সিদ্ধান্তের আগে কেন্দ্র এই অবস্থান নিয়েছে যে তারা এই বিষয়ে কিছু দিকনির্দেশনা বিবেচনা করছে। আমরা চাই না যে বিভিন্ন উচ্চ আদালত আমাদের বিভিন্ন ধরণের দিকনির্দেশনা দিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করুক।
এ প্রসঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপ সূত্র বলেছে, তাদের বিনিময় বার্তাগুলো অ্যান্ড-টু-অ্যান্ড এনক্রিপশন পদ্ধতির। চাইলেই এসব তথ্যের মধ্যে প্রবেশ করা যায় না।
অন্যদিকে বেণুগোপাল যুক্তি দিয়েছিলেন, প্রতিটি একক বার্তার প্রবর্তক সম্পর্কে তথ্য দিয়ে হবে। বিশেষ করে সন্ত্রাসী কাজের উদ্দেশ্য ব্যবহৃত বার্তাগুলো সম্পর্কে জানার প্রয়োজন আছে।
এ বিষয়ে গঠিন বেঞ্চ আরও পর্যবেক্ষণ করেছে, ‘ডার্ক ওয়েব’ পরিচালিত গেম যেমন ব্লু হোয়েল সমাজের জন্য অনেক বেশি বিপজ্জনক। তবে একই সাথে বিচারপতি গুপ্তা বলেছেন, এ জাতীয় গেমের জন্য কিছু সুরক্ষার ব্যবস্থা এবং শর্ত থাকতে হবে।
অ্যাটর্নি জেনারেল কে কে বেণুগোপাল প্রথমে হাইকোর্টকে দ্রুত সিদ্ধান্ত দেওয়ার জন্য চাপ দিলে আইনজীবী সিবাল এবং রোহাতগি বলেন, তড়িঘড়ি করে দেওয়া আদেশ আরও বেশি বিভ্রান্তির সৃষ্টি করবে।
এ বক্ত্যের প্রেক্ষিতে বেঞ্চ গুগল, টুইটার এবং ইউটিউবকে আনুষ্ঠানিকভাবে নোটিশ জারি করে। এ বিষয়ে আগামী ২ সেপ্টেম্বর শুনানির দিন ধার্য করা হয়।
এ বিষয়ে মাদ্রাজ হাইকোর্টকে মামলা চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। সঙ্গে বলা হয়, আপাতত এ বিষয়ে দেশটির হাইকোর্ট চূড়ান্ত কোনো নির্দেশ জারি করবে না।
চলমান এ প্রসঙ্গে ভারতের সাইবার আইন বিশেষজ্ঞের পুনিত ভাসিন বলেন, ভুয়া খবর ঠেকানোর প্রবণতা রোধে ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি আইন দুর্বল। ভারতের এমন কোনো আইন নেই, যার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই ইস্যুতে কাজ করতে বলা যায়। একমাত্র ভারতের দণ্ডবিধি অনুসারে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। তাদের বিরুদ্ধে বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তি আইনে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। ডেটা স্থানীয়করণসহ ভারতের এ–সংক্রান্ত আইনটিকে আরও কঠোর করা উচিত। আর তা বাস্তবায়নে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
কিছুদিন আগে ভারতের রাজ্য সভায় আইন ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী বলেছিলেন, অপরাধ সংঘটন, ঘৃণা ছড়ানো, জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদকে উসকানি দেওয়াসহ অর্থ পাচারে ইন্টারনেটকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে না দেওয়ার বিষয়ে আইন করা হবে।
ভারতে বিদেশি ইন্টারনেট প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ওই সব প্রতিষ্ঠানকে ভারতের আইন ও বিচার বিভাগের কাছে যথাযথ দায়বদ্ধ থাকতে হবে।
আইনে সংশোধন আনার পর তা টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, গুগল ও টেলিগ্রামের মতো বহুল জনপ্রিয় যোগাযোগমাধ্যমের কার্যক্রমে প্রভাব ফেলতে পারে। ভুয়া খবরের উৎস শনাক্ত করা, এনক্রিপশনের সুযোগ পাওয়া (এনক্রিপশন প্রক্রিয়ায় নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ ছাড়া আর কেউ তথ্যে প্রবেশ করতে পারে না), রাজনীতি ও নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করে এমন বিষয়, শিশু হয়রানি ও প্রতিশোধমূলক পর্নো চিত্র ছড়ানোর অভিযোগে এসব যোগযোগমাধ্যমের সঙ্গে সরকারের দীর্ঘদিনের মতবিরোধ।