উত্তর কলকাতার বুক চিড়ে চলে যাওয়া বিটি রোডের (ব্যারাকপুর ট্যাঙ্ক রোড) বেলঘড়িয়া-রথতলার কামারহাটি মোড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলেছিলেন রতন ভৌমিক। পাশেই সরকারি ছাপাখানা সরস্বতী প্রেসের আবাসিক কমপ্লেক্সের একটি ফ্ল্যাটে তিনি থাকেন। তার বিবরণটি ছিল নস্টালজিক। স্মৃতিময়। অতীতের বেদনাবহ।
প্রজন্মর পরিবর্তন নিয়ে কথা চলতে চলতে চলে এসেছিল মিডিয়া ও পাঠের প্রসঙ্গ। তিনি বলছিলেন প্রাচীন মূল্যবোধের হারিয়ে যাওয়া আখ্যান। তার কথাগুলো ছিল এ রকম:
একটা সময় উৎসবের মতো ছিল পত্রিকা পড়ার বিষয়টি। মোড়ে মোড়ে, বাসস্টপে পত্রিকা নিয়ে নিমগ্ন পাঠে লোকজন ব্যস্ত থাকতেন। গল্প-গুজব, হৈ-হট্টগোলের বদলে পাঠ্যচর্চা সত্যিই ভালো লাগতো। ছোট মুদি দোকানি বা ভবনের পাহারাদারও দিব্যি নিজের পয়সা খরচ করে কাগজ পড়তেন। পাড়ায়, মহল্লায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অফিস লাগোয়া দলীয় মুখপত্র পড়ার স্ট্যান্ড ছিল। ভিড় করে শৃঙ্খলার সঙ্গে চলত নীরব পাঠ। সেসব দিন আজ নেই।
কলকাতা সম্পর্কে উপরের যে চিত্র প্রবীণদের মুখে শুনেছি, তেমনটি অতীতের স্মৃতি। এখন দেখতে পাওয়া যাচ্ছে অন্য চিত্র। বেঙ্গালুরু থেকে ঢাকা আসার পথে কলকাতায় হল্ট করেছিলাম কয়েক দিন। নিজে দেখেছি পরিবর্তনের ঢেউ। সামাজিক জীবনে ও ব্যক্তিগত অভ্যাসের সংস্কৃতিতে চলমান পরিবর্তনের ঢেউগুলো সমুদ্র-সমান।
বাসে, ট্রেনে, পাবলিক প্লেসে তরুণ-তরুণীরা আধুনিক মোবাইল হাতে ঘুরছে। শহরের প্রায়-সর্বত্র ওয়াইফাই সুবিধা থাকায় কেউ নেটওয়ার্কের বাইরে নেই। আশ্চর্যের বিষয় হলো, কেউ চিৎকার করে ফোনে কথা বলে শব্দ দুষণ ঘটাচ্ছে না। পড়ছে বা প্রয়োজনীয় তথ্য ডাউনলোড করছে। সময়কে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে দৃষ্টান্তমূলক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে মানুষ। সচেতন ও মনোযোগী হয়েছে প্রযুক্তিকে ইতিবাচকভাবে কাজে লাগানোর দিকে। এভাবেই প্রথাগত সমাজের দক্ষিণ এশিয়ার দৃশ্যপট দ্রুতই বদল যাচ্ছে।
ঢাকায় ফিরে আসার সময় এসব কথা ভাবছিলাম। বেঙ্গালুরু, কলকাতা আর ঢাকার এরিয়াল ভিউ তুলনা করছিলাম আসা-যাওয়া সুযোগে। বেশি নয় ভূ-পৃষ্ঠ থেকে মাত্র ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার ফুট ওপরে বসে আছি এয়ারলাইন্সের অন্দরে!; সত্যিই প্রযুক্তি কোন অবিশ্বাস্য বিন্দুতে পৌঁছে দিল আমাদের!! বেশ মজা, এরপর তো অন্তরীক্ষেও দিব্যি ছেলে-মেয়েকে হোয়াটস অ্যাপ করা যাবে! আমাদের বিমানবহরে যুক্ত হওয়া 'আকাশবীণা'য় থাকছে এমনই সব অকল্পনীয় ব্যবস্থা!
প্রযুক্তি হাতে বদলে যাচ্ছে বিশ্ব, বদলাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়াও। আমরা কি সেটা অনুভব করে নিজেদের এগিয়ে নিতে পারছি। না, আমরা সেটা পারছি না। আমরা সেটা করছি না।
তাহলে আমরা কি করছি? আমরা সামাজিক-পারিবারিক-ব্যক্তিগতভাবে অশান্তি করছি প্রয়ুক্তিতে ভুলভাবে প্রয়োগ করে। বহু অশান্তির মূলে রয়েছে একটি ফেস বুক পোস্ট!! চারপাশে ভুল বার্তার বিভ্রান্তিতে বিপথগামী হচ্ছে সাধারণ মানুষ। প্রয়ুক্তির ভুল ব্যবহারের কারণে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।
বস্তুত আমরা এমন একটা সময়ে প্রবেশ করেছি যেখানে সোশাল মিডিয়া হয়ে উঠেছে যে কোনও রকম প্রতিবাদ বা প্রতিশোধের অস্ত্র, তা ব্যক্তির বিরুদ্ধে হতে পারে, কোনও বিশেষ পক্ষের বিরুদ্ধে হতে পারে, হতে পারে যে কোনও কিছুর বিরুদ্ধে! এটা এমন একটি অস্ত্র যার সামনে সবাই অসহায়, এই অস্ত্র থেকে আগুন বের হয় না, কিন্তু আগুন ধরিয়ে দিতে পারে, চোখের পলকে নষ্ট করে দিতে পারে সামাজিক শান্তি। কারো হঠকারি আচরণের মাশুল গুণতে হতে পারে একটা গোটা জনপদকে! এমনটি হচ্ছেও।
এ ব্যাপারে সচেতন হতে না পারলে, সংযম দেখাতে না পারলে আরও ভয়াবহ দিনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে আমাদের। একটু ভেবে দেখুন, আগ্নেয়গিরির ওপরে বসে আছি আমরা, সব কিছু নিয়ে ছেলেখেলার সময় এটা নয়!!!
ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার অযথা বিতর্কে না গিয়ে শান্তির সন্ধান করাই কর্তব্য। প্রয়ুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে কল্যাণ, শান্তি ও পারস্পরিক উন্নয়নে নিয়োজিত করার উদ্যোগই কাম্য। কিন্তু কাজটিি আমরা কতটুকু করছি?
ঘরে ঘরে হাই-টেকনোলজি, হাতে হাতে স্মার্ট ফোন, মুখে মুখে ইংরেজি, স্পেনীয়, ফরাসি ভাষা, চকিতে বিশ্বময় যোগাযোগ, এভাবেই বদলে যাচ্ছে বিশ্ব, বদলাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়া। আমরা বদলে যেতে পেরেছি কতটুকু?