মুলতানের দুঃখ মুছল রাওয়ালপিন্ডির সুখে!

ক্রিকেট, খেলা

তাসনীম হাসান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম ব্যুরো | 2024-08-25 18:31:56

টাইম মেশিনে চড়ে ফিরে যাওয়া যাক সেই দিনটায়। ৬ সেপ্টেম্বর, ২০০৩, শনিবার। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া-ঘরে ঘরে প্রার্থনা চলছে সকাল থেকেই। বেলা বাড়তে না বাড়তেই সব কাজ ফেলে চায়ের দোকানে-ঘরের ড্রয়িংরুমে রেডিও-টিভির সামনে জমতে শুরু করেছে ভিড়। কান পেতে ধারাভাষ্য শুনতে শুনতে আর টিভি পর্দায় ক্লান্তিহীন চোখ রাখতে রাখতে আনন্দ থেকে উৎকণ্ঠা-পারবে তো খালেদ মাহমুদের দল?

রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনটি বাংলাদেশের এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্তে শুরু হয়েছিল বিশাল এক উৎসবের অপেক্ষায়। কিন্তু সময়ের বয়স যতই বেড়েছে, ততই সেই উৎসবের প্রতীক্ষা রূপ নেয় আশাভঙ্গের নিদারুণ এক হতাশায়। বাংলাদেশের ক্রিকেট যেন সেদিন নীল হয়েছিল তীরে এসে তরি ডোবার বেদনায়। হাতের তালুর মতো নিজের চেনা মাঠে লেজের সারির ব্যাটার নিয়ে অবিশ্বাস্যভাবে পাকিস্তানকে ১ উইকেটে জিতিয়ে দেন মুলতানের সুলতান-খ্যাত ইনজামাম-উল-হক। সেই অকল্পনীয় হারের দুঃখ এতটাই হতাশার ছিল ড্রেসিংরুমে ফিরে শিশুর মতো কেঁদেছিলেন বাংলাদেশ দলের সবাই, কেঁদেছিল আপামর বাঙালি!

এরপর পেলে-ম্যারাডোনা জীবন থেকে সরে অতীত হলেন! তালেবান ক্ষমতায় এলো। ইমরান খান পদ হারালেন। পৃথিবীর চারপাশে কত কি বদলে গেল, শুধু বদলায়নি পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের টেস্টের পরিসংখ্যান! বদলা নেওয়া হয়নি সেই হারের। ২১ বছর ধরে লাল-সুবজের সমর্থকদের বুকের গহিনে জমে থাকা সেই দুঃখ অবশেষে মুছে দিল রাওয়ালপিন্ডি। গতির রাজা শোয়েব আখতারের শহর বাংলাদেশকে এমনই এক জয় উপহার দিল, যার রেশ রয়ে যাবে বহুদিন। পাকিস্তানকে তাদের ভূমিতে ১০ উইকেটে হারানো-চাট্টিখানি কথা নাকি? আর জয়টা এলো এমনই এক সময়ে-বন্যায় নিমজ্জিত হয়ে দেশের মানুষ কাঁদছে। সেই বেদনার জলে একটু যেন খুশির প্রলেপ দিল পাকিস্তান থেকে ওড়ে আসা এই ঐতিহাসিক জয়ের খবরে!

এই টেস্টে যে পাকিস্তান হারছে, সেটা আগেই জানা হয়ে গিয়েছিল। সবাই অপেক্ষায় ছিলেন কবে পড়বে পাকিস্তানের শেষ উইকেট। মেহেদি হাসান মিরাজের এলভির আবেদনে আম্পায়ার আঙুল তুলতেই তাই উৎসবের দৌড় শুরু হয়ে যায় নাজমুল শান্ত-শরিফুলদের। দৌড় কি শুধু রাওয়ালপিন্ডি ক্রিকেট স্টেডিয়ামে? ততক্ষণে যে দৌড় শুরু হয়ে গেছে বাংলাদেশের প্রতিটি অলি-গলিতে, রাজপথে। মিছিলে মিছিলে একটাই স্লোগান-বাংলাদেশ-বাংলাদেশ!

একদিকে দেশের রাজনীতিতে পালাবদল। বন্যা পরিস্থিতিতে মানুষও দিশেহারা। তার ওপর সাম্প্রতিক পারফরম্যান্সের কারণে পাকিস্তান সফরের আগে শান্তর দলটা ছিল একেবারেই আলোচনার বাইরে। সেই দলটি পাকিস্তানের মাটিতে বিশেষ কিছু করে বসবে-সেটি হয়তো স্বপ্ন দেখেননি দলেরই কেউ! কিন্তু চরম অনিশ্চয়তার খেলা ক্রিকেট যে জীবনের মতো! কাল কি হয় কেউ জানে না!

টেস্টের শুরুর দুইদিন পাকিস্তানি ব্যাটারদের দুরন্ত ব্যাটিং দেখে বাংলাদেশের সমর্থকদের অনেকেই প্রার্থনায় বসেছিলেন অন্তত ড্র-টা হলেও আসুক। তবে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে সাদমান-মুশফিক-মিরাজের ব্যাটের ছোঁয়ায়। চতুর্থদিনের শেষ সেশনে ৯৪ রানের লিড নিয়ে বাংলাদেশ ইনিংস শেষ করল-জয়ের স্বপ্ন দেখা তখনই শুরু।

একটা সময় বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জয়ের পূর্বাভাস লেখা থাকত মাশরাফি বিন মুর্তজার প্রথম স্পেলে। বাংলাদেশের সর্বকালের অন্যতম সেরা পেসার বহুদিন ধরেই অতীতের ধুলো জমা পাতায়। ম্যাশের পর মোস্তাফিজ, তাসকিন, ইবাদতসহ অনেকের হাতবদল হয়ে সেই পূর্বাভাস যেন এখন শরিফুল ইসলামের বাঁহাতে ভর করেছে! এই টেস্টে যেমন প্রথম ইনিংসে দুই রানের মধ্যেই শান মাসুদ আর বাবর আজমকে সাজঘরে ফিরিয়ে পাকিস্তানকে খাদের কিনারায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ২৩ বছরের শরিফুল। দ্বিতীয় ইনিংসেও নতুন বলে নিজের জাত চেনান অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপজয়ী বাঁহাতি পেসার, দ্রুতই ফিরিয়ে দেন সায়েম আইয়ুবকে। শরিফুলের গড়ে দেওয়া সেই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েই তো সাকিব-মিরাজরা শেষ দিনের শুরুতেই পাকিস্তানের টপ-মিডল অর্ডার ‘সাফ’ করে ফেলেন, আর দেশকে দেন জয়ের সুবাতাস! শেষ পর্যন্ত ১৪৬ রানে ‘অস্তাচলে’ যায় পাকিস্তানের ইনিংস। এরপর ৩০ রানের হাত-ছোয়া লক্ষ্যটা ফেরোতে কোনো কষ্টই হলো না জাকির-সাদমানের।

কথায় আছে, ক্রিকেট দলগত খেলা। এখানে একার হাতে ম্যাচ জেতানো যায় না। বাংলাদেশ দল সেই একতারই প্রদর্শনী দেখিয়েছে পুরো পাঁচদিন। সব ব্যাটার যেমন রান করে অবদান রেখেছেন, তেমনি প্রতিটি বোলারও প্রয়োজনের সময় উপহার দিয়েছেন উইকেট।

তার চেয়েও বড় কথা এই জয় কারও দানে পাওয়া নয়। সেই প্রথমদিন থেকেই পাকিস্তানকে এক ইঞ্চি জায়গা ছেড়ে দেয়নি বাংলাদেশ। বরং বাবর আজমের মতো এই প্রজন্মের অন্যতম সেরা ব্যাটারকে তাঁর দেশেতেই কোণঠাসা করে দিয়েছেন শরিফুল-নাহিদরা। তাই তো ২১ বছরের দুঃখ-কষ্ট মুছে দেওয়া এই জয়কে ঘিরে পাওয়া মুগ্ধতার পরিসর উপমারহিত...

এ সম্পর্কিত আরও খবর