শচীন টেন্ডুলকার হবেন না নরী কন্ট্রাক্টর?

ক্রিকেট, খেলা

তাসনীম হাসান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম ব্যুরো | 2024-01-19 21:37:51

 

মনকে আচ্ছন্ন করে দেওয়া ঝলমলে ব্যাটিং। উদীয়মান প্রতিভা। যেমন উর্বর ক্রিকেট মস্তিষ্ক তেমনই আবার ক্ষুরধার নেতৃত্বগুণ। তাতেই রেকর্ড গড়ে মাত্র ছাব্বিশ বছরেই ভারতের ক্যাপ্টেন। এর দু বছর পরেই কিনা সব শেষ! ২৮ বছরের জীবনে যা যা অর্জন করা যায় তাঁর ষোলো আনা করেও ‘সব হারিয়ে ফেলা’ মানুষটার নাম নরী কন্ট্রাক্টর।

এই যুগের ক্রিকেট ভক্তদের নরীকে না চেনারই কথা! চেনবেনই বা কি করে? নরী যে রঙিন টিভি আর হেলমেট জন্মেরও বহু আগের ধ্রুবতারা! ১৯৫৫ সালে ভারতের হয়ে নরীর টেস্ট অভিষেক। জীবনের শেষ টেস্টটা খেলে ফেললেন ১৯৬২ তেই। নামের পাশে ৩১ টেস্ট, ১৬১১ রান! পরিসংখ্যানের দিকে চোখ রাখলে হয়তো দেখাচ্ছে বড় ফ্যাকাশে, একেবারেই বিবর্ণ।

তবে নরীর ‘গোপন পরিসংখ্যানটা’ তো সমীহযোগ্যই! ২৬ বছরেই ভারতের অধিনায়ক হওয়া তো ‘অ্যান্টার্কটিকায় বরফ থাকবেই’-এর মতো সহজ নয়। হয়তো আরও কিছুদিন খেললে ফলপ্রদ দেখাত পরিসংখ্যানটা। সেটি না হলেও কি আসে যায়? বিখ্যাত ক্রীড়ালেখক নেভিল কার্ডাস তো বহু বছর আগেই বলে গিয়েছেন, ‘পরিসংখ্যান একটা আস্ত গাধা।’

নরীর সেই দুঃখগাথা শোনা যাক এবার। সময়টা ১৯৬২ সাল। সেবার ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে গেছে ভারত। প্রথমেই বার্বাডোজের বিরুদ্ধ প্রস্তুতি ম্যাচ। সে ম্যাচে যথারীতি ওপেনিংয়ে নেমেছেন নরী। কিন্তু শুরুতেই প্যাভিলিয়নের গ্লাস থেকে সৃষ্ট এক টুকরো আলোয় নরী বিভ্রান্ত হলেন খুব দ্রুত। যার ফলাফল-চার্লস গ্রিফিথের ধেয়ে আসা বাউন্সার আঘাত করল নরীর মাথায়। মুহূর্তেই উইকেটের ওপর পড়ে গেলেন তিনি। জীবন সংকটে পড়া নরীকে দ্রুত নেওয়া হলো হাসপাতালে। রক্তও লাগল প্রচুর। তাঁকে প্রথম রক্ত দেওয়া লোকটা স্বয়ং ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্যাপ্টেন, ফ্রাঙ্ক ও্যারাল!

সেই থেকে মাঠ থেকে নরীর ‘অতীত’ হওয়া শুরু। মাথার চোট সারাতে পরের দু বছরে দফায় দফায় ছুরি নিচে যেতে হলো নরীকে। পরে সুস্থ হওয়ার পর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ফিরলেও আর বিবেচিত হননি জাতীয় দলে। একটা দুর্ঘটনা একজন দুর্দান্ত প্রতিভার ক্রিকেটজীবন শেষ করে দিল আটাশেই।

এবার আসা যাক ক্রিকেট ঈশ্বরের পৃথিবীতে। ২৪ বছরের ক্যারিয়ারে নয়বার বল লেগেছিল শচীন টেন্ডুলকারের মাথায়। প্রতিবারই তাঁকে ‘বাঁচিয়ে দিয়েছে’ হেলমেট! ‘শচীন জিনিয়াস, আমরা মানুষ’-ব্রায়ান লারার এ উক্তিকে যথার্থ ধরে নিয়ে আর সর্বোচ্চ বিশ্বাস করেও এ কথা বলাই যায়, হেলমেটে কিছুটা হলেও সুবিধা পেয়েছেন ব্যাটিং-রাজা। শুধু কি শচীন, এই সময়ের ব্যাটারদের সাহসী ব্যাটিংয়ের পেছনেও পরোক্ষ অবদান তো ওই হেলমেটের। স্কুপ, রিভার্স সুইপের মতো ঝুঁকিপূর্ণ শটগুলো যে এখন ব্যাটাররা নির্ভার হয়ে খেলছেন সেটাতে কি হেলমেটের কম ভূমিকা? ওই শটগুলো খেলার সময় মাথায় তো এটাই ঘুরে-বল মাথায় লাগলেও সমস্যা কি-‘ওই যে আছে হেলমেট, বাঁচিয়ে দেবে সে!’ অবশ্য সেই হেলমেট হতে হবে মানসম্পন্ন। না হলে বল মাথায় লাগলে হেলমেটও বাঁচিয়ে দেবে না, ফিলিপ হিউজের মতো!

বাইশগজ ছেড়ে এবার আলোটা ফেলা যাক সড়কে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী সদ্য বিদায়ী বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫ হাজার ৪৯৫ টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ২৪ জন নিহত হয়েছেন। আহতের সংখ্যাও বহু। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসেব অনুযায়ী অবশ্য সেই সংখ্যাটা আরও বড়। তারা বলেছেন, ২০২৩ সালে সড়কে ৬ হাজার ২৬১ টি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে ৭ হাজার ৯০২ জনের। আহত হয়েছে ১০ হাজার ৩৭২ জন। মোট দুর্ঘটনার ৩২ শতাংশের বেশিই কিনা হয়েছে মোটরসাইকেলে। সড়কে গত বছর ২ হাজার ৩১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ২ হাজার ১৫২ জন নিহত ও ১ হাজার ৩৩৯ আহত হয়েছেন।

আগের বছরগুলোতেও প্রায় একই চিত্র ছিল। ২০২২ সালে সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসেব অনুযায়ী দুই হাজার ৯৭৩টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছিলেন তিন হাজার ৯১ জন। নিহতের মধ্যে ৭৬ দশমিক ৪১ শতাংশ ১৪ থেকে ৪৫ বছর বয়সী, অর্থাৎ বেশিরভাগই কিশোর থেকে তরুণ।

একই সংগঠন আগের বছর (২০২১) সালে ২ হাজার ৭৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ২ হাজার ২১৪ জন মারা যাওয়ার তথ্য দিয়েছিল। সেবারও নিহতদের মধ্যে ৭৪ দশমিক ৩৯ শতাংশ ১৪ থেকে ৪৫ বছর বয়সী। পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে-গত বছর মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা কিছুটা কমলেও আগের বছরগুলোতে ক্রমেই বেড়েছে।

বেসরকারি সংস্থা রোড সেফটি ফাউন্ডেশন আরেক গবেষণায় বলেছিল, দেশে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এর পেছনে অবশ্য একটা কারণও আছে। কেননা সড়কে চলা যানের বেশিরভাগই তো মোটরসাইকেল। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে বর্তমানে নিবন্ধিত মোটরযানের মধ্যে ৬০ শতাংশই মোটরসাইকেল।

মোটরসাইকেল চালাতে গিয়ে ঝুঁকি থেকে বাঁচতে মানসম্পন্ন হেলমেট পরার কোনোই বিকল্প নেই। দুই বছর আগে বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গিয়েছিল গেছে, দুর্ঘটনায় পড়া মোটরসাইকেল আরোহীদের ৮৮ শতাংশেরই মাথায় হেলমেট ছিল না। অথচ এই হেলমেট পরিধানের ফলে অনুমিত হিসাবে ৪২ শতাংশ মৃত্যুঝুঁকি এবং ৬৯ শতাংশ আহত হওয়ার ঝুঁকি হ্রাস করা যায়।

তবে এটা ঠিক সঠিক মানসম্পন্ন নয়, এমন হেলমেট পরিধানে সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস নাও হতে পারে। তাই নিম্নমানের হেলমেট পরে সড়কে নেমে গেলে পুলিশকে ফাঁকি দেওয়া গেলেও ‘মৃত্যুকে’ ফাঁকি দেওয়া কঠিনই!

কিন্তু কে শোনে কার কথা? সড়কে বের হলেই চোখের সামনে হেলমেট ছাড়া বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালানোর দৃশ্য দেখা যাবেই। বিশেষ করে কিশোরদের মধ্যে উম্মাদনাটা বেশিই। ভয়ডরহীনভাবে যেভাবে সড়কে সাপের মতো এঁকেবেঁকে মোটরবাইক চালান, সেসব দেখে মৃত্যুদূতও যেন অদূরে দাঁড়িয়ে অট্টহাসি দেয়!

তাই বলছি, ‘জীবনের ইনিংসে’ আপনি কি শচীন হবেন, না নরী কন্ট্রাক্টর হবেন-তা একান্তই আপনার ভাবনা। তবে জেনে রাখুন। শচীন হতে চাইলে মোটরসাইকেলে চেপে বসার আগে কিন্তু হেলমেট মাথায় লাগাতে হবে! তবে নরী হওয়ার ইচ্ছে থাকলে কোনো হেলমেট লাগবে না!

এ সম্পর্কিত আরও খবর