ক্যাগিসো রাবাদার ছোঁড়া বল সাকিবের ব্যাট ছুঁয়ে সীমানা স্পর্শ করতেই বাঁধভাঙ্গা উৎসব আর উচ্ছ্বাসের ঢেউ যেন বইয়ে গেল অতিথি শিবিরে। মাঠে উপস্থিত বাংলাদেশি সমর্থকদের আনন্দ আর উল্লাসটা বেড়ে হলো দ্বিগুণ। অবিশ্বাস্য জয়ে সিরিজ ট্রফি মাথার ওপর উঁচিয়ে ধরার উদযাপন তো এমনই হবে।
প্রতিপক্ষের পুঁজি ছিল অল্প। তাতেই বাংলাদেশ অনায়াসেই লিখল সাফল্যের কীর্তি গাঁথা। সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ম্যাচটি দেশের ছেলেরা জিতল ৯ উইকেটের বড় ব্যবধানে। প্রোটিয়াদের মাটিতে এটাই টাইগারদের সবচেয়ে বড় ব্যবধানে জয়। দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে প্রথম জয়ের রূপকথার গল্পটা আগেই লিখে রেখেছিল টাইগাররা।
তাসকিন-তামিম ঝলকে এবার লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা লিখল দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম সিরিজ জয়ের নতুন ইতিহাস। তামিম বাহিনী সিরিজ ট্রফি ছিনিয়ে নিয়েছে ২-১ ব্যবধানে। ম্যাচের সঙ্গে ক্রিকেট বিশ্বকাপ সুপার লিগে মূল্যবান দশটি পয়েন্টও নিজেদের নামের পাশে যোগ করেছে বাংলাদেশ। সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে জয়ের ব্যবধানটা কমিয়ে আনল টাইগাররা।
১৪১ বল হাতে রেখে জয় ছিনিয়ে নেয়ার পথে তামিম ইকবাল-লিটন দাসের উদ্বোধনী জুটিতেই ১২৭ তুলে জয়ের ভিত গড়ে ফেলে বাংলাদেশ। তবে তামিম ইকবাল দিয়েছিলেন শতক হাঁকানোর আভাস। কিন্তু আগেই দলের জয় নিশ্চিত হয়ে যাওয়ায় জাদুকরী তিন অঙ্ক ছোঁয়া হয়নি তার। দুরন্ত এক হাফ-সেঞ্চুরিতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয় এ টাইগার ক্যাপ্টেনকে। খেলেন ৮২ বলে ১৪ বাউন্ডারিতে ৮৭* রানের হার না মানা অসাধারণ এক ক্রিকেটীয় ইনিংস। তবে লিটন দাস দুই রানের আক্ষেপ নিয়ে ফেরেন। মিস করেন ফিফটি। সাজঘরে ফেরার আগে ৫৭ বলে ৮ বাউন্ডারিতে এনে দেন তিনি ৪৮ রানের দাপুটে এক ইনিংস। দুজনের ব্যাটিং দৃঢ়তায় ২৬.৩ ওভারে মাত্র এক উইকেট হারিয়েই লক্ষ্য টপকে ১৫৬ তুলে জয়ের কেতন উড়ায় বাংলার দামাল ছেলেরা। দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে একটি মাত্র উইকেট নেন কেশব মহারাজ। তিনি ফিরিয়ে দেন ওপেনার লিটন দাসকে। পরে তামিমকে সঙ্গ দিয়ে দলের জয় নিশ্চিত করেই মাঠ ছাড়েন সাকিব আল হাসান (১৮*)। সেই বিজয়ের উচ্ছ্বাসেই ভেসে যায় টাইগাররা।
আগুন ঝরা একটি দিনই কাটিয়েছে বাংলাদেশের বোলাররা। বিধ্বংসী বোলিংয়ে প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের শুরু থেকে শুধু চাপেই রাখেনি টাইগাররা। বোলিং তোপে প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের নাস্তাবুদ করে ছেড়েছেন তারা। যার শুরুটা করেন মেহেদী হাসান মিরাজ। হঠাৎ বল হাতে জ্বলে উঠেন দুরন্ত ফর্মে থাকা এ স্টার ক্রিকেটার। ঘূর্ণি জাদুতে কুইন্টন ডি কককে ফিরিয়ে ব্রেকধ্রু এনে দেন তারকা এ অলরাউন্ডার। পরে বোলিং আক্রমণের হাল ধরেন তাসকিন আহমেদ। বল হাতে রীতিমতো তুলে ফেলেন বোলিং ঝড়। একাই পাঁচ উউকেট শিকার করে দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটিং-লাইন আপে নামিয়ে দেন ধস। পরে তাসকিন-মিরাজের সঙ্গে যোগ দেন শরিফুল ইসলাম ও সাকিব হাসান। লাল-সবুজের প্রতিনিধিদের ধ্বংসাত্মক বোলিংয়ে ব্যাটিং ধস সামলে উঠতে না পেরে সবকটি উইকেট হারিয়ে ৩৭ ওভারে ১৫৪ রানের পুঁজি গড়ে দক্ষিণ আফ্রিকা।
তবে প্রোটিয়াদের শুরুটা ছিল দারুণ। দুরন্ত ব্যাটিংয়েরই আভাস দিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। দুই ওপেনার জানেমান মালান ও কুইন্টন ডি কক দেখে শুনে খেলতে থাকেন। ব্যাটিংয়ে ঝলকে দেন বড় সংগ্রহের ইঙ্গিত। কিন্তু টাইগারদের বোলিং তোপে সেই ধারাটা ধরে রাখতে পারেনি প্রোটিয়া। ধসে পড়তে থাকে তাদের ব্যাটিং লাইন-আপ। টাইগারদের বোলিং তোপের মুখে দাঁড়াতেই পারেননি প্রোটিয়ারা। দলের হয়ে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ৩৯ রানের ইনিংস খেলেছেন ওপেসার জানেমান মালান। ২৮ রান আসে কেশব মহারাজের ব্যাট থেকে। দলীয় স্কোরে ২০ রান যোগ করেন ডোয়াইন প্রিটোরিয়াস। তাদের সঙ্গে ডেভিড মিলার ১৬ ও কুইন্টন ডি কক ১২ রান এনে দেন। বাকি ব্যাটসম্যানরা থেকে যান সিঙ্গেল ডিজিটে।
বাংলাদেশের জার্সি গায়ে ৩৫ রান খরচায় ৫ উইকেট শিকার করেছেন সিরিজসেরা ও ম্যাচসেরা তাসকিন আহমেদ। এনিয়ে একদিনের ক্রিকেটে দ্বিতীয়বারের মতো পাঁচ উইকেট শিকারের কীর্তি গড়লেন তারকা এ পেসার। তবে এটি তার ওয়ানডে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় সেরা বোলিং ফিগার। ভারতের বিপক্ষে অভিষেক ম্যাচে ক্যারিয়ারসেরা বোলিং করেছিলেন তাসকিন। তার বোলিং ফিগার ছিল ৫/২৮। তার সঙ্গে দুটি উইকেট নেন সাকিব আল হাসান। একটি করে উইকেট পান মেহেদী হাসান মিরাজ ও শরিফুল ইসলাম।
তার আগে সেঞ্চুরিয়নের সুপারস্পোর্টস পার্কে টস ভাগ্য সহায় হয়নি টাইগার ক্যাপ্টেন তামিম ইকবালের। এই মাঠেই প্রথম ম্যাচ জিতেছিল টাইগাররা। এবার সিরিজ জেতার দ্বিতীয় জয়টাও ধরা দিল একই মাঠে। সিরিজ নির্ধারণী ম্যাচে টস জিতে নেন টেম্বা বাভুমা। টস জিতেই ব্যাটিং বেছে নেন প্রোটিয়া ক্যাপ্টেন। তাই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডেতে টস হেরে শুরুতে বল হাতে মাঠে নেমে দক্ষিণ আফ্রিকাকে অল্পতে আটকে দেয় বাংলাদেশ। তবে ম্যাচে বাংলাদেশের একাদশে কোনো পরিবর্তন আসেনি। আগের দুই ম্যাচের অপরিবর্তিত দল নিয়েই মাঠে নামে লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা। এনিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার আগে আফগানিস্তানের বিপক্ষে হোম সিরিজেও একই দল নিয়ে তিনটি ওয়ানডে খেলেছে টাইগাররা। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার একাদশে একটি পরিবর্তনে আসে। প্রোটিয়াদের দল থেকে বাদ পড়েন ওয়েন পারনেল। তার জায়গায় খেলেন ডোয়াইন প্রিটোরিয়াস।
বাংলাদেশ একাদশ: তামিম ইকবাল (অধিনায়ক), লিটন দাস, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম (উইকেটরক্ষক), ইয়াসির আলী, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, আফিফ হোসেন, মেহেদী হাসান মিরাজ, তাসকিন আহমেদ, শরিফুল ইসলাম ও মুস্তাফিজুর রহমান।
দক্ষিণ আফ্রিকা একাদশ: কাইল ভেরেইন (উইকেটরক্ষক), জানেমান মালান, টেম্বা বাভুমা (অধিনায়ক), কুইন্টন ডি কক, রসি ভ্যান ডার ডাসেন, ডেভিড মিলার, তাবরাইজ শামসি, কেশব মহারাজ, ক্যাগিসো রাবাদা, ডোয়াইন প্রিটোরিয়াস ও লুঙ্গি এনগিদি।