ক্ষমতার ক্রোড়ে জন্ম নেওয়া বিএনপি'র চার দশক

বিএনপি, রাজনীতি

মায়াবতী মৃন্ময়ী, অতিথি লেখক, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 23:36:01

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) আজ শনিবার (১ সেপ্টেম্বর) ৪১ বছরের সময়সীমা স্পর্শ করলো। সামরিক শাসনের ধারাবাহিকতার এক পর্যায়ে ফৌজি শাসক ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠা করেন দলটি। দলের ৪১ বছরের শুরুর দিনটিতে বর্তমান চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া রয়েছেন কারাবন্দি। তার অনুপস্থিতিতে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও দীর্ঘদিন ধরে লন্ডনবাসী।

ক্ষমতার ক্রোড়ে জন্ম নেওয়া বিএনপি চার দশক পেরিয়ে আসার বছরটিতে ক্ষমতার বাইরে থাকার সাম্প্রতিক তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে পথ চলছে। সঙ্গে রয়েছে শীর্ষ দুই নেতার বিরুদ্ধে মামলার চাপ, নেতৃত্বের সঙ্কট আর দিশাহীন সাংগঠনিক অবস্থার ক্ষত। দলের জন্মের পর সবচেয়ে সঙ্কুল ও বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি নেতা ও কর্মীরা চরম হতাশা ও উদভ্রান্তির মধ্যে রয়েছেন।

যদিও ৪০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকায় সমাবেশের কর্মসূচি দিয়েছে বিএনপি, তথাপি তা এক আনুষ্ঠানিকতার নামান্তর মাত্র। শনিবার বিকালে রাজধানীর নয়া পল্টনে সমাবেশ করবে দলটি। এতে দলের স্থায়ী কমিটিসহ সিনিয়র নেতারা অংশ নেবেন। এর আগে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিন সকালে প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের কবরে ফুল দেবেন দলের নেতারা। পরদিন ২ সেপ্টেম্বর ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্স (রমনা) মিলনায়তনে বিএনপির ৪০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা সভা হবে। এসব কর্মসূচি দলনেত্রীর মুক্তি ও নির্বাচন সম্পর্কে দলের দোদুল্যমানতা কাটাতে আদৌ কোনও কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে কিনা, তা দলের ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বাণীতে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘এবারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অঙ্গীকার খালেদা জিয়ার মুক্তি, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে হারানো ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনা এবং বাক-ব্যক্তি ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাসহ জনগণের মানবিক মর্যাদা সুরক্ষা করা।’

তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমান দুঃসময়ে জনগণকে সংগঠিত করার কোনও বিকল্প নেই। দেশ আজ দুঃশাসন কবলিত। বারবার অবরুদ্ধ গণতন্ত্রকে যিনি মুক্ত করেছেন, সেই অবিসংবাদিত নেতা খালেদা জিয়াকে বানোয়াট মামলায় সাজা দিয়ে বন্দি করে রাখা হয়েছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলায় সাজা দেওয়া হয়েছে। এই সব প্রতিহিংসামূলক জুলুমের বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। মুক্ত করে আনতে হবে আমাদের প্রিয় নেত্রী বেগম জিয়াকে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে সব ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে হবে।’

চার দশক পার হওয়ার সময়ের এই প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে দল ও শীর্ষ নেতৃবৃন্দের প্রতি মহাসচিবের অঙ্গীকারের কথাগুলো বাস্তবে দলের সর্বস্তরে কতটুকু প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব সৃষ্টি করবে, সে সম্পর্কে পর্যবেক্ষকদের দ্বিধা রয়েছে। কারণ, আন্দোলনের মাঠে একের পর এক ব্যর্থতা আর কৌশল ও কর্মসূচি প্রণয়ন ও পালনের অক্ষমতা দলটিকে সাংগঠিকভাবে সবচেয়ে নাজুক পর্যায়ে নিয়ে এসেছে।

দ্বিধা ও সিদ্ধান্তহীনতার ঘুর্ণাবর্তে নিমজ্জিত বিএনপি অতীতের চার দশকে ক্ষমতার স্বাদ অনেক পেলেও রাজনৈতিক দক্ষতা অর্জনের সক্ষমতা দেখাতে পেরেছে খুবই কম। দলের ইতিহাস বলছে যে, রাজনৈতিক সংগ্রাম ও মতাদর্শের লড়াই করে নয়, ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার জন্যই দলটির সৃষ্টি। ফলে ক্ষমতার বাইরের বিএনপি দৃশ্যত অকার্যকর রাজনৈতিক দলের বেশি আর কিছু হতে পারছে না।

বিএনপির ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিকাল পাঁচটায় রাজধানী ঢাকার রমনা রেস্তোরাঁয় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এক সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র পাঠের মাধ্যমে বিএনপির যাত্রা শুরু হয়। সংবাদ সম্মেলনে নতুন দলের আহ্বায়ক কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি প্রথমে ১৮ জন সদস্যের নাম ঘোষণা করেন। পরে ১৯৭৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ওই ১৮ জনসহ ৭৬ সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। এর আগে ১৯৭৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি জিয়াউর রহমান প্রথমে ‘জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল’ (জাগদল) গঠন করেন। যদিও দলটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন তৎকালীন উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার। ২৮ আগস্ট ১৯৭৮ সালে নতুন দল গঠন করার লক্ষ্যে জাগদলের বর্ধিত সভায় ওই দলটি বিলুপ্ত ঘোষণা হয়।

বিএনপি সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্য মতে, রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠার আগে ১৯৭৭ সালের ৩০ এপ্রিল জিয়াউর রহমান তার ‘সামরিক শাসন’-কে ‘বেসামরিক’ করার উদ্দেশ্যে শুরু করেন ১৯ দফা কর্মসূচি। অনেক ভাঙা-গড়া আর উত্থান-পতনের পথে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সুদীর্ঘ ৪০ বছর পার করতে গিয়ে বিএনপি চারবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল। দু’বার জাতীয় সংসদে বিরোধী দল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে। কিন্তু টেকসই রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক শক্তিমত্তা দলটিতে কখনোই গড়ে উঠতে পারে নি। মূলত ক্ষমতার রাজনীতি ও শীর্ষ নেতৃত্বের চরম আধিপত্যের কারণে বিএনপিতে গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব মোটেও বিকশিত হতে পারে নি। যে কারণে বিরাট জনসমর্থনের দলটি শীর্ষ স্থানীয়দের পছন্দের ও মনোনীত কমিটির মাধ্যমে বিদ্যমান রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও চাপ মোকাবেলা করতে বার বার ব্যর্থ হচ্ছে।

ক্ষমতায় ও ক্ষমতার বাইরে থেকে বিগত চার দশকে বিএনপি নির্বাচনী রাজনীতিতে অনেক সাফল্যজনক অর্জনের অধিকারী হলেও গত নির্বাচন বর্জনের মতো হটকারিতা এবং আসন্ন নির্বাচন সম্পর্কে সিদ্ধান্তহীনতা দেখিয়েই চলেছে। অথচ ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ২০৭টি আসন পেয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসে বিএনপি। এরপর ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান নিহত হন। ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি বিএনপির প্রাথমিক সদস্যপদ গ্রহণ করে রাজনীতিতে আসেন তাঁর স্ত্রী খালেদা জিয়া। ১৯৮৪ সালের ১০ মে দলের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হয় খালেদা জিয়া। এরপর থেকে তিনি দলটির চেয়ারপারসনের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ১৯৯১ সালে ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার নেতৃত্বে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। ১৯৯৬ সালের বির্তকিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে স্বল্প দিনের জন্য প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন খালেদা জিয়া। ১৯৯৯ সালে চারদলীয় ঐক্যজোট গঠন করে বিএনপি। এরপর ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট ভোটের লড়াইয়ে জিতে সরকার গঠন করে। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন এবং ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হলে বিএনপি জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন বয়কট করে বিএনপি। এই সিদ্ধান্তের চড়া মাশুল দিতে হয়েছে বিএনপিকে। এ কারণে সংসদীয় রাজনীতির ধারা থেকে ছিটকে পড়তে হয়েছে বিএনপিকে। সামনের নির্বাচন নিয়ে আবার কোনও ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত বিএনপির ভবিষ্যতকে আরও অন্ধকারে ঠেলে দেবে। প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর দিনে বিএনপিকে এই রূঢ় বাস্তবতাকেও মাথায় রাখতে হবে।

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর