‘উন্মুক্ত’ নির্বাচন: স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের নিরাপত্তা

, রাজনীতি

কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-12-28 15:32:18

দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে দল মনোনীত প্রার্থী আছে। আছে মনোনয়নবঞ্চিত স্বতন্ত্র প্রার্থী। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বিভক্ত। জায়গায়-জায়গায় জড়াচ্ছে সংঘর্ষ-সহিংসতায়। এরইমধ্যে প্রাণ গেছে দুজনের, আহত হয়েছেন অনেকেই। এক পক্ষ আরেকপক্ষকে দেখে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন, এলাকা ছাড়া করার ঘোষণা দিচ্ছেন, কল্লা ফেলে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন, হাত-পা ভাঙা, এলাকাছাড়া করার হুমকি তো আছেই। নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর আরও সপ্তাহ দিন বাকি, উত্তপ্ত হয়ে গেছে দেশ। কিছু এলাকা বাদে সারাদেশই পুড়ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ আগুনে।

দলের মনোনীত প্রার্থীদের বাইরে কেউ নির্বাচনে দাঁড়ালে তাদেরকে বহিস্কার করা থাকে। কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে কিংবা দেখাতে স্বতন্ত্র প্রার্থিতাকে উৎসাহিত করেছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। মনোনয়নপ্রত্যাশীদের নিয়ে গণভবনে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেছেন, কেউ বিনা প্রতিন্দ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। স্বতন্ত্র প্রার্থিতাকে উৎসাহিত করতে তিনি কাউকে চাপ প্রয়োগ করে বসিয়ে যাতে দেওয়া না হয় সে বিষয়ে জোর দেন। অর্থাৎ যারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী তাদের প্রতি গভীরভাবে সংবেদনশীল ও যত্নশীল।

সারা দেশের ৩০০ সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে মনোনয়ন ফরম কেনা ৩ হাজার ৩৬২ জনের মধ্যে প্রথম দফায় ২৯৮ আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়। এরপর জাতীয় পার্টি ও ১৪-দলীয় জোট নেতাদের জন্যে ছেড়ে দেওয়া হয় আরও কিছু আসন। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আনুষ্ঠানিকতা শেষের পর ৩০০ আসনের মধ্যে ২৬৪ আসনে আছে আওয়ামী লীগের প্রার্থী। এরবাইরে আছে দলের মনোনয়নবঞ্চিত তিন শতাধিক স্বতন্ত্র প্রার্থী। দলীয় প্রতীকের প্রতিনিধিত্ব করা লোকদের চাইতে আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত নেতারাই বেশি অংশ নিচ্ছেন নির্বাচনে।

দলের মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন যারা তাদেরকে বলা হচ্ছে ‘ডামি প্রার্থী’। আওয়ামী লীগের এই ডামি বা বিকল্প প্রার্থীদের দিয়েই সরগরম নির্বাচনের মাঠ। নির্বাচনে ৪৪টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের ২৮টি অংশ নিচ্ছে, কিন্তু ওইসব দলের নাম ও প্রতীক অনেকটাই অপরিচিত ভোটারদের কাছে। অনেকে প্রার্থী হয়ে নির্বাচনী প্রচারণা চালানো দূরের কথা পোস্টার-লিফলেট প্রকাশ করেছেন কিনা এনিয়েও সন্দেহ রয়েছে। প্রায় দুই হাজারের মতো প্রার্থী নির্বাচনে, কিন্তু প্রচার-প্রচারণায় আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং জাতীয় পার্টির কিছু প্রার্থী। এরবাইরে বাকিরা কাগজেকলমে। ফলে নির্বাচনের লড়াই মূলত আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের সঙ্গে স্বতন্ত্রের মোড়কে আওয়ামী লীগ নেতাদেরই। নির্বাচনী প্রচারণার যতটুকু হচ্ছে, সেটা কেবল তাদের দ্বারাই।

নির্বাচনী প্রচারণার এই সময়ে দেশের জায়গায়-জায়গায় সৃষ্টি হয়েছে ভয়ের পরিবেশ। সংঘর্ষের পাশাপাশি হুমকি-ধমকি চলছেই। হুমকি দিচ্ছেন যারা তাদের প্রায় সকলেই আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা। প্রান্তিক পর্যায়ের নেতা থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার-চেয়ারম্যান, সংসদ সদস্য, এমনকি কয়েকজন মন্ত্রীও আছেন এই হুমকি দেওয়ার দলে। মন্ত্রী-এমপি যখন প্রকাশ্যে হুমকি দেন, তাদেরকে ভোট না দিলে দেখে নেওয়া হবে বলে প্রকাশ্য উচ্চারণ করেন, সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি থেকে বাদ দেওয়ার হুমকি দেন, তখন সত্যিই ভীতিপ্রদ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। কয়েকজন সংসদ সদস্যের দ্বারা ইতোমধ্যেই কিছু সাংবাদিক নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকেরা এই বাচিক ও শারীরিক আক্রমণের কেন্দ্রে রয়েছেন।

স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগের নেতা। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ তাদের প্রার্থিতাকে ইতিবাচকভাবে দেখেছে। প্রচলিত নির্বাচনী রাজনীতিতে তারা ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’ হলেও আওয়ামী লীগের নতুন কৌশলের নির্বাচনী রাজনীতিতে তারা এখন বিদ্রোহী নন। কিন্তু দেশের নানা প্রান্তে শেখ হাসিনার ‘ডামি’ প্রার্থীরাও ‘বিশ্বাসঘাতক’ তকমা পাচ্ছেন, হুমকি পাচ্ছেন, নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন। সারাদেশে আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড পর্যায়েরও নেতাকর্মী আছেন। পুরো পাঁচ বছর এই নেতাকর্মী ও কমিটি নিষ্ক্রিয় থাকলেও নির্বাচনের সময়ে বিবিধ লাভালাভের আশায় অনেকেই সক্রিয়, অনেকেই সক্রিয় দলের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শনে। এই সাংগঠনিক কাঠামো কিংবা শক্তি দল মনোনীত প্রার্থীদের পক্ষে রয়েছে। ফলে আওয়ামী লীগের নেতা হলেও অনেক স্বতন্ত্র প্রার্থী সেভাবে সাংগঠনিক সহায়তা পাচ্ছেন না। এই সুযোগে অভ্যন্তরীণ প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করতে অনেকেই মরিয়া হয়ে ওঠেছেন।

এখন পর্যন্ত গণমাধ্যমে যত তথ্য এসেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, দলীয় প্রার্থীর কর্মী-সমর্থক ও নেতাদের দ্বারা নিপীড়নের শিকার স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকেরা। সামগ্রিক চিত্র হয়ত গণমাধ্যম সেভাবে ধারণ করতে পারছে না, তবে যেটুকু খবর আসছে সেটাই ভীতিকর। নির্বাচনী প্রচারণায় বাধা দানের ঘটনা নিয়মিত বিষয়। এমন অবস্থায় অনেকেই প্রচারণা চালাতে পারছেন না, অনেকেই নিজেদের গুঁটিয়ে নিতে বসেছেন ভয়ে।

সারাদেশের নির্বাচনী পরিবেশের পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া কঠিন। সবগুলো ঘটনা গণমাধ্যমে আসে না, আইনি সহায়তা বেশিরভাগই চায় না। থানা-পুলিশে যাওয়ার সাহস অনেকেই করে না মূলত আস্থার সংকটে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন, এবং অভিযোগ দিলে পুলিশ কি যথাযথ ব্যবস্থা নেবে—এই প্রশ্ন জোরাল হয়ে ওঠেছে। যদিও নির্বাচন কমিশন মাঠপর্যায়ের প্রশাসনে ব্যাপক বদলি করেছে, কিন্তু নতুন কর্মস্থলে আসা কর্মকর্তারা যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার ‘সাহস’ দেখাতে পারেন কিনা এনিয়েও রয়েছে সন্দেহ।

গত ১৮ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়েছে আনুষ্ঠানিক প্রচারণা। চলবে আরও এক সপ্তাহ। গত ১০ দিনের নির্বাচনী পরিবেশ সুখকর নয় বলে মনে হচ্ছে না। অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল আজ জাতীয় মানবাধিকার চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমরা মাঠ পর্যায়ে সভা করেছি। তাদের কাছ থেকে খুব বেশি অভিযোগ পাইনি। প্রশাসনের ওপর তাদের আস্থা রয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সহিংসতা, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, পোস্টার ছেঁড়াছেড়ি হয়েছে। কিন্তু মোটাদাগে খুব বেশি ঘটনা ঘটেছে বলে মনে হয় না। তবে সহিংসতা একেবারেই হয়নি, সেটা বলছি না। আমরা আমাদের আবেদন রাখছি, প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি, তারা যেন এটা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন।’ নির্বাচনী সহিংসতায় দুই-দুইটা প্রাণের অপচয়ের পরেও যদি সিইসি এটাকে ‘মোটাদাগের ঘটনা’ না মনে করেন, তবে এটা দুঃখজনক।

৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে নির্বাচন। নির্বাচনের পর পরই সারাদেশে ব্যাপক সহিংসতা কিংবা একপাক্ষিক নিগ্রহের ঘটনা ঘটতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে। এই শঙ্কা দূরীকরণে এখনই উদ্যোগী হতে হবে। নির্বাচনী সহিংসতায় ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন অগণন হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ। এবারের নির্বাচনের পর হিন্দুরা সেই অর্থে সে রকমের শঙ্কার মধ্যে নেই সত্য, তবে হুমকির মুখে রয়েছেন সারাদেশের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকেরা। তাদের রক্ষা করতে হবে। তা না হলে নির্বাচনের চাইতে বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবে অনুমিত অনাকাঙ্ক্ষিত এই নিগ্রহ!

এ সম্পর্কিত আরও খবর