সবচেয়ে বড় বাণিজ্য হলো এমপিগিরি
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আমার নেতৃত্বেই প্রথম মিছিল হয়েছিল
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর প্রথম প্রতিবাদ করেছিলাম আমি
নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তদারকির সরকার চাই
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি ও গণতান্ত্রিক বাম জোটের অন্যতম নেতা। তুখোড় ছাত্রনেতা ও ডাকসুর সাবেক সভাপতি। দেশের সাম্প্রতিক রাজনীতি, নির্বাচন, ছাত্র রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী রাজনৈতিক উত্থান পতনের ইতিহাসের নানা দিক নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হয়েছিলেন ‘বার্তা২৪’ এর।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: সত্য কথা বলতে দেশ আজ নানা দিক থেকে গভীর সংকটে। হয়তো রাজনৈতিক সংকটটা দৃশ্যমান বেশি এবং মানুষ এটা নিয়ে বেশি আলোচনা করে। কিন্তু আমি যখন সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলি, তখন দেখি, তারা নির্বাচন নিয়ে চিন্তা করে বটে, কিন্তু তারা আরও বেশি চিন্তিত তাদের ন্যূনতম মজুরি নিয়ে। গার্মেন্টসের শ্রমিকদের দাবি, তাদের ন্যূনতম মজুরি হতে হবে ১৬ হাজার টাকা। কিন্তু সরকারি ঘোষণা দেয়া হলো এর অর্ধেক। যদি ন্যূনতম প্রয়োজনের অর্ধেক মজুরি দেয়া হয়, তাহলে সরকারি সব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনও যা পায় তার অর্ধেক হওয়া উচিত?
দেশের উন্নয়ন ও জিডিপি অনেক দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে-এ রকম একটি হিসাব আমাদের সামনে তুলে ধরা হয়, কিন্তু আমাদের মোট সম্পদ বাড়ছে ঠিকই, কিন্তু সেই সঙ্গে বৈষম্যের হার বাড়া এ কথাই প্রমাণ করে যে এ সম্পদ সবার মধ্যে সমবন্টন হচ্ছে না। আমরা দেখতে পাচ্ছি, অর্থনীতির মধ্যে লুটপাটের ধারা বহুদিন ধরেই চলছে। এর একটি অশুভ প্রভাব আমাদের অর্থনীতি, সমাজ এমনকি রাজনীতির ভেতরেও অনুপ্রবেশ করেছে। রাজনীতিতেও এখন সবকিছু কেনা-বেচা ও লেনদেনের বিষয় হয়ে গেছে। নমিনেশন বাণিজ্য, ভোট বাণিজ্য, সিট বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য, অবসর বাণিজ্য, বদলি বাণিজ্য। কোথায় বাণিজ্য নেই?
আর সবচেয়ে বড় বাণিজ্য হলো ‘এমপিগিরি’। আমাদের রাজনীতি বাণিজ্যিকীকরণ ও দুর্বৃত্তায়ন দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পড়েছে।
আমাদের ফিরে যেতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়। আমাদের বামপন্থিদের ভিশন হলো- ভিশন মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১।
ইলেকশন নিয়ে আমরা আইয়ুব খানের আমল থেকেই সংগ্রাম করেছি। ‘এক লোক, এক ভোট’, ‘সার্বজনীন ভোটাধিকার দিতে হবে, দিতে হবে’। সে ভোট আদায় হলো, ভোটে জনগণ রায় দিলো। কিন্তু ভোটের সেই রায় কার্যকর করতে না দেওয়ায় আমাদের অস্ত্র হাতে সংগ্রাম করে রায় কার্যকর করতে হলো।
মুজাহিদুল: মুক্তিযুদ্ধের যে চিন্তা ও ধারা ছিল সেখান থেকে দেশকে সম্পূর্ণ উল্টো দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পাশাপাশি পুঁজিবাদি লুটেরা ধনিক শ্রেণি এখন ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। যখন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমরা দেশ স্বাধীন করলাম এবং তিনি সরকার গঠন করলেন, তারপর থেকেই অবস্থা পরিবর্তন হতে থাকে। তার আগে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিতো মধ্যবিত্ত শ্রেণি। দলটির নেতৃত্ব এখন মধ্যবিত্তের হাতে নেই। দুর্ভাগ্যজনকভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা এখন সম্পদ আহরণের উৎস হয়ে গেছে। আর বিএনপির জন্মই হয়েছে লুটেরা ধনিক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার জন্য।
মুজাহিদুল: জনগণ চাক বা না চাক যে কোনও ভাবেই ক্ষমতায় যাওয়ার মানসিকতাই সুষ্ঠু নির্বাচনের ধারাবাহিকতা নষ্ট করেছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে নীতি-মতাদর্শগত বিরোধ নেই সেটা আমি বলবো না। তবে মূল বিরোধ হলো লুটপাটের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্ব।
মুজাহিদুল: সম্প্রতি যে ঐক্য হয়েছে তা আসলে বিদ্যমান দ্বিদলীয় কাঠামোর মধ্যেই ঘোরপাক খাচ্ছে। এর মাধ্যমে বরং আসল বিকল্পের সংগ্রামটিকে দুর্বল করা হচ্ছে। আমরা বামপন্থীরা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে গিয়ে বিকল্প শক্তি গড়তে চাই। সে লক্ষ নিয়ে আমরা অগ্রসর হচ্ছি। আর নতুন ঐক্য প্রক্রিয়াটি এখনো প্রসেসে। বিএনপি ও বিএনপির সঙ্গে যে ২০ দল তাদের সঙ্গে নিয়ে একটি সরকারবিরোধী জোট গঠন করা হচ্ছে। সেটা তারা করুক। কিন্তু আমরা মনে করি, এক দু:শাসন নামিয়ে আরেক দু:শাসন ক্ষমতায় বসিয়ে আসল সমস্যার সমাধান হবে না। ফুটন্ত কড়াই থেকে বাঁচতে জ্বলন্ত চুলায় ঝাপ দিলে কোনো কাজ হবে না। বিপদ সরিয়ে আপদ আনলে কাজ হবে না। আমাদের মু্ক্তিযুদ্ধের ধারায় অগ্রসর হতে হবে।
মুজাহিদুল: আওয়ামী লীগের ইতিহাসে অনেক উত্থান-পতন। একসময় ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ছিল। যখন সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্ব নিলেন তখন দলটি ডানপন্থী হয়ে গেলো। আবার বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এটি ধীরে ধীরে মধ্য-বামপন্থী ধারায় আসলো। সেখান থেকে আবার ডান ও মধ্য-ডান অবস্থাতে ফিরে এসেছে।
মোশতাক বঙ্গবন্ধুকে পরামর্শ দিয়েছিল সমাজতন্ত্র বাদ দিয়ে পুঁজিবাদের পথ ধরতে, ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে বাজার অর্থনীতির পথ ধরতে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু মোশতাকের কথা শোনেননি। মোশতাকের পরামর্শ ছিল সমাজতন্ত্র বাদ দিয়ে বাজার অর্থনীতি চালু করা। আমি সবিনয়ে আওয়ামী লীগের কাছে জিজ্ঞেস করতে চাই, আওয়ামী লীগ এখন বঙ্গবন্ধুর নীতিতে চলছে না মোশতাকের নীতিতে? বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আমার নেতৃত্বে প্রথম মিছিল হয়েছিল। প্রথম প্রতিবাদ করেছিলাম আমি। অনেক নেতাই সেদিন মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিল। এরপর সামরিক শাসনের মাধ্যমে দেশ মুক্তিযুদ্ধের ধারা থেকে সরে গেলো। এরপর আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এসেছে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের মূল ধারায় দেশকে ফিরিয়ে নিয়ে যায়নি। ধর্ম নিরপেক্ষতায় প্রত্যাবর্তন করতে পারেনি। জামায়াতে ইসলামকে এখনও নিষিদ্ধ করা হয়নি। এসব নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি খেলা করছে।
অনেকে আমাদের বলে, আপনারা কি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি থেকে সমদূরত্বের নীতিতে চলেন? না, আমরা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি থেকে দূরত্ব মেপে আমাদের দলের নীতি ঠিক করি না। তারাই আমাদের থেকে দূরত্ব মেপে নীতি ঠিক করে। কাজেই কাছে আসার সুযোগ কম। কারণ, আওয়ামী লীগের শ্রেণি চরিত্র বদলে গেছে। আগে ছিল মধ্যবিত্তের নেৃতৃত্বে পরিচালিত দল, এখন হয়েছে লুটেরা ধনিক শ্রেণি দ্বারা পরিচালিত দল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শুধু মুখে বললে হবে না। গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা মানতে হবে।
মুজাহিদুল: আমরা এরশাদের বিরুদ্ধে যখন লড়াই করি, তখন তিন জোটের রূপরেখা প্রণিত হয়। সেটা ড্রাফট করার দায়িত্ব আমরা ওপরই ছিল। প্রথম ড্রাফটে বলেছিলাম যে আগামী তিনটা নির্বাচন তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করতে হবে। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া- দুজনেই এতে আপত্তি করলেন। তাই ওটা রাখা হয়নি। আমরা চেয়েছিলাম নির্বাচনের ওপর মানুষের বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু এখন পর্যন্তও মানুষ বিশ্বাস করে, দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব না।
সরকার থেকে বলা হলো, অক্টোবরের মাঝামাঝি নির্বাচনকালী সরকার গঠন করা হবে। কিন্তু সংবিধানে নির্বাচনকালীন সরকার বলতে কিছু আছে কি? নাই। সরকার বলছে, নির্বাচনকালীন সরকারের কাজ হবে ‘রুটিন কাজ’। কিন্তু সংবিধানে ‘রুটিন কাজ’ বলে কিছু নেই। সরকার বলছে, শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন হবে। কিন্তু সংবিধানে আছে নির্বাচন হবে নির্বাচন কমিশনের অধীনে। তাই সব কিছুই একটা প্রহসন। আমি এটাকে বলি ঐন্দ্রজালিক প্রহসন। আমরা নিরপেক্ষ তদারকির সরকার চাই। আজ্ঞাবহ কমিশনকে সরিয়ে দিতে হবে। সংসদ বহাল রেখে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনেক জটিলতা সৃষ্টি করবে। আমরা বলেছি, সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা চালু করতে হবে। যে দল যতো শতাংশ ভোট পাবে ততো শতাংশ সিট পাবে। না ভোট দেয়ার সুযোগ দিতে হবে। নির্বাচনে সাম্প্রদায়িকতার ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। নির্বাচনের খরচ রাষ্ট্র চালাবে। নির্বাচন কমিশন সব তদারকি করবে। সব সরকারি খরচে হবে। প্রজেকসন মিটিং হবে। সেখানে প্রার্থীরা কথা বলবেন। অনেক দেশেই এ সিস্টেম আছে।
মুজাহিদুল: নাসিম সাহেব কয়েকদিন আগে বলেছেন, মেসি-রোনাল্ডো পেনাল্টি মিস করতে পারে, কিন্তু শেখ হাসিনার পেনাল্টি মিস হবে না। পেনাল্টি যাতে মিস না হয়, সে ব্যবস্থা করা হয়েছে। শোনা যায়-এটা অনুসন্ধান করে দেখতে হবে-সংসদে আইন পাস হওয়ার আগেই ও নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগেই চার হাজার টাকার ইভিএম কেনার জন্য এলসি খুলে দেয়া হয়েছে। কে এই এলসি খুললো? এখানে কি কি লেনদেন হয়েছে? এসব যোগসূত্র খুঁজে দেখতে হবে। এসব ইঞ্জিনিয়ারিং কলাকৌশল থেকে বের হতে হবে। সামরিক শাসনের সময়ও এসব কলা কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে।
মুজাহিদুল: ছাত্র রাজনীতি আসলে অবদমিত। ছাত্র রাজনীতি হচ্ছে যেটা আমরা গণজাগরণ মঞ্চে দেখেছি, যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ হয়েছে সেখানে এবং সাম্প্রতিক নিরাপদ সড়কের জন্য কিশোর বিদ্রোহও এর উদাহরণ। কিন্তু সাধারণ ছাত্রদের এ জাগরণকে দমন করে রেখেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে দখল করে রাখা এক ধরনের মাস্তান ও ক্যাডার বাহিনী। মিছিল না করলে, নেতার পেছন পেছন না ঘুরলে হলে সিট দেয়া হবে না-এসব চলছে। ছাত্র রাজনীতির নামে টেন্ডারবাজি-চাদাবাজি, লোকজনকে ধরে নিয়ে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করা হচ্ছে। যদি ছাত্র নির্বাচন হয় তবেতো এসব হবে না। তাই নির্বাচনও হচ্ছে না। এর সাথে যুক্ত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একটা অশুভ অংশ। দু:খের বিষয় শিক্ষকদের একটা অংশও এর সাথে জড়িয়ে পড়েছে। দেশে সব নির্বাচন হচ্ছে, কিন্তু ছাত্র নির্বাচন হচ্ছে না। ছাত্রসংসদের জন্য ফি দিতে হচ্চে ছাত্রদের। কিন্তু ছাত্রসংসদ নেই। সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধি নেই ২৮ বছর। অথচ, দরকার বছর বছর নির্বাচন। কিন্তু সেটি হচ্ছে না।
মুজাহিদুল: আমি বলতে চাই, দেশকে আমাদের স্বপ্নের মতো করে, মনের মতো করে গড়ে তুলতে হলে অনেক কিছু করতে হবে। আমি সবিনয়ে দর্শকদের বলতে চাই-মনে রাখবেন জমি বর্গা দেয়া যায়, কিন্তু স্বার্থ কখনো বর্গা দেয়া যায় না। যার যার স্বার্থ নিয়ে নিজে নিজের সংগঠন, সমিতি এগুলো গড়ে তুলুন। কৃষকরা কৃষকের সংগঠন গড়ে তুলুন, শ্রমিকরা শ্রমিকের সংগঠন গড়ে তুলুন। ছাত্ররা ছাত্রদের। নিজেরা সক্রিয় হয়ে মাঠে নামেন। আপনার স্বার্থ আপনাকেই আদায় করে নিতে হবে। গ্যালারিতে বসে খেলা দেখলে হবে না। জনগণের প্রকৃত বিকল্প শক্তিকে চিহ্নিত করে তাদেরকে সামনে নিয়ে আসার জন্য ব্যবস্থা করেন। তাহলেই আমরা সবাই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে দেশ গড়তে পারবো।
মুজাহিদুল: বার্তা২৪ কেও অনেক ধন্যবাদ