পহেলা বৈশাখ প্রাকৃতিক নিয়মে বাংলা নববর্ষকে নিয়ে এসেছে বসন্তের উজ্জ্বল নীলাকাশ ও উজ্জ্বলতর সবুজ প্রকৃতির পরশ মাখিয়ে। তবু করোনায় আক্রান্ত নতুন বছর ১৪২৭ বঙ্গাব্দে পৃথিবীর রং ধূসর। মানুষের চেহারা ভীত-বিহ্বল, পাণ্ডুর। প্রকৃতির পাতায় পাতায় ও নিসর্গের প্রতিটি অঙ্গনে ‘এসো হে বৈশাখ, এসো হে’ স্পন্দন, তবু এই নববর্ষের, এই পহেলা বৈশাখের, সকল রুদ্রতা অবরুদ্ধ।
এই অচিন্তনীয় অবরুদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে সামাজিক দূরত্ব ও সঙ্গরোধের ফলে। মনুষ্য চলাচলহীন, নিস্তরঙ্গ পৃথিবীতে ঘরবন্দী হয়ে বেঁচে থাকাই বিরাট বড় চ্যালেঞ্জ। উৎসবের প্রসঙ্গ তো রীতিমতো অকল্পনীয় বিষয় করোনাপীড়িত কালে।
তবুও গৃহের নিভৃত কোণ থেকে চিরচেনা, চিরপরিচিত প্রকৃতি ও ঋতুর অনিন্দ্য পালাবদল মানুষের দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারে না। মানুষ, প্রকৃতির শিহরণ থেকে দূরে থাকলেও নির্বিকার থাকতে পারে না। উৎসবমুখর বাঙালি অন্তরের আলো ও উত্তাপে আমোদিত হয় নববর্ষের স্পর্শে, পহেলা বৈশাখের পরশে।
বাংলা জনপদে বাঙালি জীবনে পহেলা বৈশাখ নবতর চেতনায় উজ্জীবিত হওয়ার আনন্দধ্বনি নিয়ে আসে। পুরনো ও জীর্ণকে ফেলে ‘ঐ নতুনের কেতন’ উড্ডয়নের ডাক দেয় বৈশাখ। আবাহন জানায়, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল বাঙালির ঐক্য, বিকাশ ও সমৃদ্ধির।
দক্ষিণ এশিয়ার সুবিশাল ভূগোলের মধ্যে বিশাল ও বহুবিচিত্র ভারত উপমহাদেশে একমাত্র বাঙালি জাতিরই রয়েছে নিজস্ব ও কার্যকরী একটি বর্ষপঞ্জি, যাকে কেন্দ্র করে বাঙালির অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক জীবন আবর্তিত হয় ঋতুবৈচিত্র্য এবং পালা, পার্বণ ও অনুষ্ঠানের সমান্তরালে। মাটি ও মানুষের সম্মিলনে সেই বর্ষক্রমের সূচনা আনে রুদ্র বৈশাখ।
বৈশাখে বাঙালির জাতীয় সাংস্কৃতিক জাগরণের মতো আলোড়ন তৈরি হয়। ঢাকাসহ পুরো বাংলাদেশ ঘর ছেড়ে বাইরে চলে আসে। শতসহস্র কণ্ঠে বলতে থাকে, ‘এসো মিলি প্রাণের উৎসবে’।
ভোরের নতুন আলোয় রমনার ঐতিহ্যবাহী বটমূলের সুর ও ছন্দে আবাহন করা হয় নতুন বছরকে। চারুকলা, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয় বর্ণিল শোভাযাত্রা। প্রত্যয়দীপ্ত বাঙালি অশুভ, অন্যায় ও অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর ডাক দেয়। বাঙালির শতকণ্ঠে জাগৃতির গানে গানে সমগ্র বাংলাদেশ মুখরিত হয় নববর্ষের প্রথম দিনে, পহেলা বৈশাখে।
কিন্তু ঐতিহাসিক বাস্তবতার কঠিন পরিস্থিতিতে ১৪২৬ বঙ্গাব্দ শেষে নতুন বছর ১৪২৭ এসেছে ঘোরতর সঙ্কুলতার মধ্যে। শুধু বাংলাদেশই নয়, সারা বিশ্বই এই নতুন বছরের মাহেন্দ্রক্ষণে তাপিত, পীড়িত। উৎকণ্ঠায় প্রকম্পিত। তবু মানুষের শাশ্বত সংগ্রামশীলতার শক্তিতে চলছে সঙ্কট মোচনের লড়াই। রোগের সঙ্গে মানুষের এই প্রচণ্ড দ্বৈরথে বিশ্বের প্রতিটি মানুষই আজ একেক জন সৈনিক। হয়তো কেউ লড়াই করছে বাইরে থেকে, কেউ ঘরের মধ্যে থেকে। তথাপি লড়াই চলছেই।
মানব সভ্যতার এই লড়াইয়ে বাঙালিকে আরও প্রাণিত করে বৈশাখের জীবনমুখী চৈতন্য। রুদ্র বৈশাখের প্রবল প্রতাপে করোনা-সৃষ্ট অবরুদ্ধতাকে পরাজিত করার প্রত্যয় ও প্রতীতি জাগে নববর্ষের নবতর আবহে, পহেলা বৈশাখের প্রাণময় স্পর্শে। যে পরশ প্রতিটি বাঙালি ঘরে বসেও অনুভব করে। উপলব্ধি করে প্রাণের আলোয় বিপদ উত্তরণের প্রেরণা। সামষ্টিক উৎসবময়তাকে পায় ব্যক্তিগত, পারিবারিক পরিমণ্ডলে।
মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির, প্রাণের সঙ্গে প্রাণের মিলিত মুখরতায় বাঙালির চিরন্তন উৎসব বাংলা নববর্ষের পহেলা বৈশাখ। বাঙালি যেকোনও পরিস্থিতিতে এই সর্বজনীন, কল্যাণময় উৎসবের সঙ্গে একাত্মবোধ করবেই। হয়তো বাইরের সব আয়োজন আপতকালীন পরিস্থিতিতে স্থগিত থাকবে। কিন্তু নববর্ষের নতুন আলোয় অন্তরের রজতশুভ্র আলোক দ্যুতিতে বাংলার প্রতিটি প্রান্তর, গৃহকোণ আলোকোজ্জ্বল হবেই। নতুন আলোয় জাগবেই প্রাণ।
আজ নয় কাল, অবরুদ্ধ প্রহর পেরিয়ে বাঙালি জাগবেই রুদ্র বৈশাখের উচ্ছ্বাসে। অবরুদ্ধ রুদ্র বৈশাখেও বাঙালির ঘরে ঘরে, অন্তরের গহীন প্রদেশে জাগবে প্রাণ।
বাংলার, বাঙালির সংবাদ সারথি বার্তা২৪.কম বাংলার, বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখে ঘরে ঘরে অবস্থানরত প্রতিটি বাঙালিকে জানাচ্ছে আন্তরিক শুভেচ্ছা।