বিশ্ব সৌন্দর্যের লীলাভূমি নৈসর্গিক সুন্দরবন। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ৩ লাখ মানুষের রুটি-রুজির উৎস এ বন বছরের অধিকাংশ সময়েই থাকে অরক্ষিত ও অনিরাপদ। দেশের অর্থনীতিতে সুন্দরবনের অবদান প্রতিবছর প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা হলেও জনবল সংকটের মধ্য দিয়ে চলে সুন্দরবনের বন বিভাগ। রক্ষকরাই থাকেন অরক্ষিত অবস্থায়।
বনবিভাগের সূত্র থেকে জানা যায়, বনে ব্যবহারের জন্য নেই আধুনিক নৌযান, আধুনিক অস্ত্র, প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি, যানবাহনের অভাব, বনরক্ষীদের রেশন, ঝুঁকিভাতা ও চিকিৎসা সেবার কোনো সুবিধাই নেই। একইসঙ্গে নতুন করে নিয়োগ না দেয়া এবং বয়সের কারণে অবসরে যাওয়ায় শূন্য পদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সব মিলিয়ে সুন্দরবনে লোকবল সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। অপ্রতুল জনবল নিয়ে দস্যু, চোরা-শিকারি, বনজীবী ও মৎস্যজীবীদের অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছে বনবিভাগ। জীবন ঝুঁকিতে আছেন বনরক্ষীরা। প্রতিনিয়তই যেন মৃত্যু ঝুঁকি, মৃত্যু হলেও তাদের পরিবারকে দেয়া হয়না কোনো বেতন-ভাতা। আধুনিক সকল সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত সুন্দরবনের বনরক্ষীরা। নিরাপত্তাহীনতায় দুই যুগে অন্তত ১২ জন বনরক্ষী প্রাণ হারিয়েছেন।
বনবিভাগ খুলনা সার্কেলের তথ্যমতে, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের মোট আয়তন ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার। বনের দুটি বিভাগ পূর্ব ও পশ্চিম। বিভাগ দুটির আওতায় রয়েছে চারটি রেঞ্জ। এর মধ্যে বাগেরহাট অংশের তিন উপজেলা শরণখোলা, মোরেলগঞ্জ ও মংলাসংলগ্ন। পূর্বসুন্দরবনকে শরণখোলা ও চাঁদপাই দুটি রেঞ্জে ভাগ করা হয়েছে। এ রেঞ্জের অধীনে আটটি স্টেশন ও ৩০টি ফাঁড়ি। এখানে প্রতি আট বর্গকিলোমিটারে বনরক্ষী মাত্র একজন। পশ্চিম বিভাগে খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার কয়রা, দাকোপ, শ্যামনগরসংলগ্ন খুলনা ও সাতক্ষীরা দুটি রেঞ্জে বিভক্ত। এ দুটি রেঞ্জের অধীন নয়টি স্টেশন। বনের ভেতরে রয়েছে শতাধিক খাল। এসব খাল-নদী দেখভালের জন্য ক্যাম্প আছে ৭৬টি।
বন বিভাগ খুলনা সার্কেলের সূত্র মতে, বন বিভাগ খুলনা সার্কেলে ১ হাজার ১৭৩টি মঞ্জুরিকৃত বিভিন্ন পদ রয়েছে। যার মধ্যে শূন্যপদের সংখ্যা প্রায় ৩ শতাধিকের বেশি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য উপ বন সংরক্ষক থেকে সহকারী বন সংরক্ষক ৭টি পদের মধ্যে ৩টি, ফরেস্টার রেঞ্জার ৩০টি পদের ৪টি, ফোরম্যান ২টি পদের মধ্যে ১টি, ইঞ্জিন ড্রাইভার ৩১টি পদের ১৮টি, প্রধান সহকারী ৩টি পদের ১টি শূন্য রয়েছে। স্টোনো টাইপিস্ট ২টি পদের ১টি, হিসাব রক্ষক ৩টি পদের ১টি, ডেপুটি রেঞ্জার ৪৫টি পদের ৪৩টি, বেতারযন্ত্র চালক ৮টি পদের মধ্যে ৩টি, ফরেস্টার ১০৫টি পদের মধ্যে ২১টি, সারেং ১৭টি পদের ৯টি, ডাটা এন্ট্রি অপারেটর ২টি পদের ১টি, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর ১৪টি পদের ১টি, কার্পেন্টার ৩টি পদের ১টি, ড্রাইভার ৫টি পদের ২টি, স্পিডবোট ড্রাইভার ১৪টি পদের ১টি, সুকানি ৬টি পদের ৩টি, বন প্রহরী ১৯১টি পদের মধ্যে ৮৩টি খালি রয়েছে।
আবার অফিস সহায়ক ২৭টি পদের মধ্যে খালি রয়েছে ১টি, নৌকা চালক ৫৪৬টি পদের ৫৫টি, টেন্ডল ৫টি পদের ২টি, ডেক ক্যাশব ৩টি পদের ২টি, ওয়েলম্যান ৩টি পদের ১টি, খালাসী ৪৩টি পদের ৯টি, হেডমালি ১০টি পদের ২টি শূন্য রয়েছে। জনবল সংকট থাকায় অনেকটা নিয়ন্ত্রণহীন ও অরক্ষিত হয়ে পড়েছে সুন্দরবন।
সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের বনরক্ষী আব্দুল্লাহ আকবর বলেন, বনে তো ২৪ ঘণ্টা ডিউটি দিতে হয়। এখানে বিশুদ্ধ পানির সংকট, চাহিদামতো খাদ্য সরবরাহ আর অসুস্থতায় চিকিৎসার অভাব। নেই বনরক্ষীদের মধ্যে নিরবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থাও। সুন্দরবনে সম্পদ রক্ষায় ১৬ স্টেশন ও যে ৬৩টি টহলফাঁড়ি রয়েছে সেগুলোও নিরাপদ নয়। ঝড় জলোচ্ছ্বাস থেকে বনরক্ষীদের রক্ষায় সামান্য ঝুঁকি ভাতা মিললেও মেলেনা রেশনসহ অন্য সুবিধা। এমনই নানা প্রতিকূলতায় জীবন কাটছে সুন্দরবন রক্ষার দায়িত্বে থাকা বনরক্ষীদের।
সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা বশিরুল আল মামুন বলেন, সুন্দরবনে প্রয়োজনের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ জনবল ঘাটতি রয়েছে। তারপরও ইকোপার্ক এলাকায় প্রয়োজনীয় জনবল রাখা হয়। কারণ, সেখানে জনবল কম থাকলে পর্যটকরা সঠিক ও প্রয়োজনীয় সেবা থেকে বঞ্চিত হবেন। ইকোপার্কে জনবল দিতে গিয়ে বনের ভেতরে টহল ও পাহারায় ঘাটতি পড়ে। জনবল সংকটের এ প্রকট সমস্যা সমাধান করা না হলে বিস্তীর্ণ বনভূমির সম্পদ রক্ষা করা কষ্টসাধ্য।
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, সুন্দরবন সুরক্ষায় দায়িত্বে থাকা বনবিভাগের লোকবল সংকট প্রচুর। এছাড়া নিয়মিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অবসরে যাচ্ছেন। সে অনুপাতে আবার নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না। এজন্য জনবল সংকটের ফলে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে সম্পদ চুরি, অবৈধ মৎস্য শিকার রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। শিগগিরই শূন্য পদে দ্রুত জনবল নিয়োগ হওয়া দরকার। বন সুরক্ষায় এটা এখন অবশ্যই প্রয়োজন।
খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মঈনুদ্দিন খান বলেন, বনবিভাগের স্টাফ, বনরক্ষী দাবি ও জনবল সংকটের কথা একাধিকবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিলে এ সংকটের সমাধান হবে। বর্তমানে সুন্দরবন রক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এজন্য বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের অপেক্ষায় মন্ত্রণালয়ে রয়েছে।