'ইগো' থেকেই সগিরার নিখুঁত হত্যা

ঢাকা, জাতীয়

শাহরিয়ার হাসান ও মনি আচার্য্য, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম, ঢাকা | 2023-09-01 07:20:52

রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুলের সামনে ১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাইয়ের জনাকীর্ণ বিকেলে খুন হন সগিরা মোর্শেদ। গত ৩০ বছর ধরে সকলে জেনে আসছে ছিনতাইকারীদের গুলিতেই এই নারী খুন হন। কিন্তু এর পেছনের গল্পটা ছিল অজানা। সত্য কখনো চাপা থাকে না। আর সে নিয়মেই দীর্ঘ সময় পর বেরিয়ে আসে হত্যাকাণ্ডের আসল রহস্য। ছিনতাইকারীর গুলিতে নয়, বরং প্রতিহিংসার গুলিতেই প্রাণ যায় সগিরার।

ঘটনার দিন যে রিকশায় সগিরা মোর্শেদ ছিলেন, সেই রিকশাচালকের তথ্যেই প্রায় ৩০ বছর পর উঠে আসে খুনের আসল রহস্য। গেল বৃহস্পতিবার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) সগিরা হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত রহস্য উদঘাটন করতে সমর্থ হয়।

কেন খুন হতে হল এই নারীকে, পিবিআই'য়ের তদন্তে বেরিয়ে আসে এই তথ্য। তারা বলছে, পারিবারিক ইগো ও সামাজিক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে সগিরাকে হত্যা করা হয়। আর এই হত্যাকাণ্ডের ছক এতই নিখুঁত ছিল যে, ঘুণাক্ষরেও কারো এই হত্যা সম্পর্কে কোনো কিছু সন্দেহ করার অবকাশ ছিল না। সকলের সামনে এটি ছিল নিছকই ছিনতাইকারীর গুলিতে মৃত্যু।

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) লোগো

সগিরা মোর্শেদ হত্যা মামলার তদন্তের দায়িত্বে থাকা ঢাকা মেট্রো দক্ষিণ পিবিআই কর্মকর্তারা বলছেন, এই নাটকীয় হত্যাকাণ্ডের সূত্রপাত ঘটে নিহত সগিরার স্বামী ও মামলার বাদী সালাম চৌধুরীর রাজধানীর রাজারবাগের পেট্রোল পাম্পের পৈত্রিক বাড়ি থেকে। তিন ভাইয়ের মধ্যে সালাম চৌধুরী সবার ছোট। বাদীর মেঝো ভাই ডা. হাসান আলী চৌধুরী ও তার স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা শাহীনের পারিবারিক ইগো ও সামাজিক স্ট্যাটাসজনিত নানা জটিলতায় খুন হতে হয় সগিরাকে।

পারিবারিক ইগো ও সামাজিক স্ট্যাটাস জনিত সমস্যা সৃষ্টির নেপথ্য:

এই হত্যাকাণ্ডের প্রায় ৪ বছর আগে থেকে সমস্যার শুরু। ১৯৮৫ সাল নাগাদ সগিরার সঙ্গে ডা. হাসান ও তার স্ত্রী শাহীনের পারিবারিক ইগো ও সামাজিক স্ট্যাটাসের সমস্যা সৃষ্টি হয়। বাদীর স্বামী সালাম চৌধুরী ইরাক ও ডা. হাসান লিবিয়া থেকে ফেরার পর সায়েদাবাদের পৈত্রিক বাড়ির দুই তলায় পাশাপাশি কক্ষে বসবাস শুরু করেন। আর সেখান থেকেই সগিরার সঙ্গে ইগোজনিত দ্বন্দ্বে জড়ান শাহীন।

এই ইগোর মূল কারণ ছিল সগিরা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স পাস এবং অন্যদিকে শাহীন সাধারণ ডিগ্রি পাস। এছাড়া ধর্মপ্রাণ সগিরা ছিলেন শাশুড়ির প্রিয়, যা মোটেও মেনে নিতে পারেননি শাহীন।

ডা. হাসান আলী চৌধুরী ও সায়েদাতুল মাহমুদা শাহীন, আনাস মাহমুদ রেজওয়ান ও মারুফ রেজা

তিন কন্যা সন্তানের জননী সগিরার বড় মেয়ে সেই সময়ে ভিকারুননিসা নূন স্কুলে পড়ত; কিন্তু শাহীনের ছেলে-মেয়ে ভালো স্কুলে পড়ত না। তাই সগিরা থেকে সামাজিক স্ট্যাটাসে নিজেকে ছোট মনে করতেন শাহীন।

অন্যদিকে হত্যাকাণ্ডের অন্যতম অভিযুক্ত শাহীনের ভাই আনাস মাহমুদ রেজওয়ান মনে করতেন উচ্চশিক্ষিত হওয়ায় তাকে সম্মান করতেন না সগিরা। আর সেই ইগোর কারণে হত্যাকাণ্ডের ছক আঁকেন আনাস।

এ বিষয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও ঢাকা মেট্রো দক্ষিণ পিবিআই’র পরিদর্শক রফিকুল ইসলাম বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, আর্থিক বা স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কারণে নয় শুধুমাত্র ইগো ও সামাজিক স্ট্যাটাসের কারণে সগিরাকে নিখুঁত পরিকল্পনায় হত্যা করা হয়।

যেভাবে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়:

অবশেষে সগিরাকে উপযুক্ত শিক্ষা দিতে মনস্থির করেন ডা. হাসান ও শাহীন। তাই পূর্ব পরিচিত মারুফ রেজাকে নিজের চেম্বারে ডেকে সগিরাকে শাস্তি দেওয়ার অনুরোধ করেন ডা. হাসান। বিনিময়ে তাকে ২৫ হাজার টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। নগদ টাকা পেয়ে লোভ সামলাতে পারেনি মারুফ। তাই ডা. হাসানের প্রস্তাবে রাজি হয়ে হত্যাকাণ্ডের বেশ কয়েক দিন আগে একটি রিভলবার সংগ্রহ করেন।

কিন্তু নতুন সমস্যা এসে হানা দেয় এই পরিকল্পনায়। ভাড়াটে খুনি মারুফ চেনেন না সগিরাকে। সমস্যা নিরসনে আনাসকে পরিকল্পনায় সামিল হওয়ার জন্য প্রস্তাব দেন ডা. হাসান। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয় যান আনাস। পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘটনার দিন মারুফ ও আনাস ছিনতাই করার আড়ালে ভিকারুননিসার সামনে রিকশায় থাকা সগিরাকে গুলি করে। আর এতেই নিহত হন তিনি।

এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রো দক্ষিণ পিবিআই’র বিশেষ পুলিশ সুপার শাহদাত হোসেন বলেন, হত্যার পরিকল্পনাকে আড়াল করতে ছিনতাইয়ের আশ্রয় নেয় হত্যাকারীরা। ইগো সমস্যার কারণেই পরিবারের লোকের পরিকল্পনায় খুন হতে হয় সগিরাকে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর