পরপর দুই রেল দুর্ঘটনা, দায়‌ এড়াতে পারছে না কর্তৃপক্ষ

ঢাকা, জাতীয়

তৌফিকুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম, ঢাকা | 2023-08-23 14:42:30

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা মন্দবাগ রেল স্টেশনে মঙ্গলবার (১২ নভেম্বর) তূর্ণা নিশীথার সঙ্গে উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেনের ভয়াবহ সংঘর্ষ হয়েছে। তাতে প্রাণ হারিয়েছেন ১৬ জন। আহত হয়েছেন শতাধিক যাত্রী।

এ দুর্ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে বৃহস্পতিবার বিকেলে আবারও দুর্ঘটনার কবলে পড়ে ট্রেন। পশ্চিমাঞ্চল রুটের ঢাকা থেকে লালমনিরহাটগামী রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেনটি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া স্টেশনের কাছে গেলে বগি লাইনচ্যুত হয়ে আগুন ধরে যায়। এতে কেউ নিহত না হলেও বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। এ দুই দুর্ঘটনায় দায়িত্বরত রেল কর্তৃপক্ষের কর্তব্যে অবহেলার বিষয়টি লক্ষ্যণীয়।

প্রাথমিকভাবে এ দুই দুর্ঘটনার জন্য রেল সংশ্লিষ্ট দায়িত্বরত কর্মকর্তারা অনেকাংশে দায়ী বলে জানা গেছে। দু’টি দুর্ঘটনার পরপরই রেলওয়ের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করে দেয়া হয়েছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ট্রেন দুর্ঘটনায় তদন্ত কমিটি সূত্রে জানা যায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনায় প্রাথমিকভাবে রেলের চালকদের গাফিলতি পাওয়া গেছে। এজন্য অভিযুক্ত ঢাকাগামী তূর্ণা নিশীথা ট্রেনের লোকো মাস্টার (এলএম) তাছের উদ্দিন, সহকারী লোকো মাস্টার (এএলএম) অপু দে ও গার্ড আবদুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্তও করা হয়েছে।

রেল সূত্রে আরো জানা যায়, অভিযুক্ত লোকোমাস্টারদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুর্ঘটনাস্থলের আগে বাইরের (আউটার সিগন্যাল) মাত্র কয়েক সেকেন্ড দেখা যায়। ডাবল লাইন কাজের জন্য পাথর স্তুপ করে রাখায় সিগন্যাল ঠিকমত দেখা যায় না। তাছাড়া মান্দাবাগে চট্টগ্রামগামী ট্রেন ক্রস করবে, সেটা তূর্ণা নিশীথা এক্সপ্রেসের চালক ও গার্ডকে ফোনে জানানো হয়নি।

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেন সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় রংপুর এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনা প্রসঙ্গে বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে ঘটনাস্থলে থাকা ভুক্তভোগীদের কথা শুনে জানা গেছে, ঢাকা থেকে রওনা হওয়া লালমনিরহাটগামী রংপুর এক্সপ্রেসের দুই নম্বর লাইন দিয়ে উল্লাপাড়া রেলস্টেশনে ঢোকার কথা ছিল। কিন্তু দায়িত্বরত পয়েন্ট ম্যান এক নম্বর লাইনে সিগন্যাল দিয়ে দেন। এতে ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হয় এবং ট্রেনের তে‌লের ট্যাংক ফে‌টে বগিতে আগুন লেগে যায়। সুতরাং প্রাথমিক তদন্তে সিগন্যাল ভুলের কারণে এবং দায়িত্বরত পয়েন্ট ম্যানের দায়িত্ব পালনে অবহেলার বিষয়টি উঠে এসেছে। পুরোপুরি তদন্ত শেষে অভিযোগের বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাবে।

এদিকে, গত ১০ বছরে রেল কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী, তিন হাজার ৪৮৬টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। যাতে প্রায় চারশ’ যাত্রীর প্রাণহানি ঘটেছে। এসব ঘটনার পর একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত শেষে কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয় ও কিছু সুপারিশও করে। কিন্তু সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, নিলে হয়তো ট্রেন দুর্ঘটনা কম হতো। তবে বেশিরভাগ দুর্ঘটনার জন্য ট্রেনচালক, গার্ড ও স্টেশন মাস্টারকে দায়ী করা হয়েছে।

পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ দুটি দুর্ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্টেশনের দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলার বিষয়টি স্পষ্ট। মাঠ পর্যায়ের অভিযুক্ত কর্মকর্তারা যেমন দায় এড়াতে পারে না, ঠিক একইভাবে বাংলাদেশ রেলওয়ে উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারাও দায় এড়িয়ে যেতে পারেন না। চালকদের আধুনিক প্রশিক্ষণের অভাব, অদক্ষ কর্মচারী, রেললাইন সংস্কার না হওয়া ও দুর্বল সিগন্যাল ব্যবস্থার ফলে ঘটছে এ ধরনের দুর্ঘটনা।

সার্বিক বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের সাবেক মহাপরিচালক আবু তাহের বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, রেল একটি টেকনিক্যাল বিষয়, খুব সুক্ষভাবে চলাচল করে, সামান্য ত্রুটির কারণে ঘটতে পারে বড় দুর্ঘটনা। পরপর দু’টি রেল দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর বিষয়টি সবাইকে নাড়া দিয়েছে। কেন এবং কার ভুলে এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে, তা খুঁজে বের করে দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

সম্প্রতি রেল দুর্ঘটনা নিয়ে বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক কাজী সাইফুল নেওয়াজ বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, রেল সেক্টরে এখন আধুনিক প্রযুক্তি চলে এসেছে। কোনো লোকো মাস্টার যদি সিগন্যাল দেখতে না পায়, তারপরও প্রযুক্তির মাধ্যমে অটোমেটিক ট্রেনকে দাঁড় করানো সম্ভব। সুতরাং লোকো মাস্টারের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে ট্রেনে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। কারণ একটি ট্রেনে হাজার হাজার যাত্রী থাকে।

তিনি আরো বলেন, রেল লাইনের নিচে মাটি ও পাথর থাকে না। রেল ট্র্যাকের কানেকশন পয়েন্টগুলোতে সমস্যা থাকে। এগুলো মেনটেনেন্সের অভাবে ট্রেন লাইনচ্যুত হয় এবং বড় বড় দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। বিদেশ থেকে কোচ আমদানি করার সময় রেল কর্তৃপক্ষের খেয়াল রাখতে হবে। অগ্নি নিরোধক মেটেরিয়াল সমৃদ্ধ কোচ নিতে হবে। তাহলে আগুন দ্রুত লাগবে না।

রেলের নিয়মিত ইনস্পেকশন হয় না উল্লেখ করে তিনি বলেন, রেল সেক্টরে নিয়মিত ইনস্পেকশন হওয়া দরকার। রেলে ইনস্পেকশন করতে হবে অভিজ্ঞ টেকনিশিয়ানদের। নিয়মিত অডিট করে সমস্যা সমাধান করতে হবে। তাহলে এ ধরনের দুর্ঘটনা কমে আসবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর