অপরিকল্পিত পুকুর খনন, জলাবদ্ধতায় ১০ হাজার বিঘা জমি

, জাতীয়

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2025-01-11 17:59:10

নাটোরের লালপুরে এক সময় বসন্তপুর বিল ডুবলে ডুবে যেত গোটা লালপুর উপজেলা। সেই উঁচু জায়গায় এখন জলাবদ্ধতার কবলে।পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। খালের মুখে অবৈধভাবে অপরিকল্পিত পুকুর খনন করায় সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে অনাবাদিভাবে পড়ে আছে বিলের ১০ হাজার বিঘা জমি। বিগত বছরে কয়েকবার বিলের পানি নিষ্কাশনের উদ্যোগ নিলেও হয়নি কার্যকর কোনো সমাধান। এতে বিলে জন্মেছে কচুরিপানা ও জলজ আগাছা। ফলে মানবেতর জীবনযাপন করছেন বিলে ফসল উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কৃষক ও শ্রমিকরা। এদিকে চলতি মৌসুমেও বোরো ধানের আবাদ নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বিলটি প্রায় ১০ কি.মি দীর্ঘ ও ৩ কি.মি চওড়া। এ বিলের পানি নিষ্কাশনের জন্য নব্বইয়ের দশকের শুরুতে উদ্যোগ নেয়া হয়। দুড়দুড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান আজিজুল আলম এলাকাবাসীকে এই কাজে উদ্বুদ্ধ করেন। তখন তিনি তাঁদের জমিতে সরকারি ব্যয়ে একটি খাল খনন করেছিলেন। বর্ষাকালে এই খাল হয়ে বিলের পানি পার্শ্ববর্তী রঘুনাথপুর, হাসেমপুর ও আকবর পুর হয়ে আরেকটি খালের মাধ্যমে নাটোরের চন্দনা নদীতে পড়তো। তখন থেকে এই বিলে বছরে ৩ বার ফসল উৎপাদিত হতো। পড়ে থাকতো না এক ইঞ্চি জমি। বিলের চারপাশে বসবাসকারী ২০ টি গ্রামের মানুষের কাছে বিলটি হয়ে উঠেছিল আশীর্বাদ।

২০ টি গ্রামের মানুষের কাছে বিলটি হয়ে উঠেছিল আশীর্বাদ

কিন্তু ২০১২ - ২০১৩ সাল থেকে বিলে কয়েকজন প্রভাবশালী সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান অবৈধভাবে পুকুর খনন শুরু করলে বন্ধ হয়ে যায় বিলের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা। এতে বিপাকে পড়েন বিলে আবাদকারী কৃষকেরা।

২০১৯ সালের ২৪ মার্চ বিলের ফসলি জমিতে অবৈধভাবে পুকুর খনন বন্ধ ও জলাবদ্ধতা নিরসনের দাবিতে লিখিত অভিযোগ, উপজেলা পরিষদ চত্বরে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করে এলাকাবাসী। ২০১৯ সালের ১২ মে হাইকোর্ট একটি রিট শুনানি করে উপজেলার কৃষি জমিতে পুকুর খনন বন্ধে নির্দেশ দিলেও বন্ধ করা যায়নি অবৈধ পুকুর খনন।

২০২০ সালের ২৪ আগস্ট লালপুরের তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মুল বানীন দ্যুতি ভুক্তভোগী চাষিদের দিয়ে ৪২টি পুকুরের পাড় কেটে সাময়িক পানিনিষ্কাশনের ব্যবস্থা করেন। স্থায়ীভাবে পানিনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ২০২২ সালের ১ মার্চ নাটোর-১ (লালপুর-বাগাতিপাড়া) আসনের সংসদ সদস্য শহিদুল ইসলাম বসন্তপুর বিলের সঙ্গে চন্দনা নদীর সংযোগ খাল সংস্কারের জন্য প্রায় এক কোটি টাকার একটি প্রকল্প উদ্বোধন করেন।

কিন্তু, বিলের ১ কি.মি খাল খনন করার পর ব্যক্তি মালিকানাধীন ১.৫ কি.মি জমি সরকারিভাবে অধিগ্রহণ না করায় বাকি অংশে আর খাল খনন করা সম্ভব হয়নি। ফলে বর্ষাকালে পানি বন্দি হয়ে পড়ে বিলের চারপাশের ২০ টি গ্রাম। দীর্ঘদিন পানিবন্দি থাকায় এলাকার মানুষ রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। অনেক সময় ঘটে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর ঘটনা। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে আবারো উপজেলা ও জেলা প্রশাসনকে বিষয়টি অবহিত করা হয়। কিন্তু এখনো দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

খালের মুখে পুকুর খনন করায় বিলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে

ভুক্তভোগী চন্ডিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক (অব:) নজরুল ইসলাম বলেন, "বিলে আমাদের পরিবারের ৫০ বিঘা জমি রয়েছে। জলাবদ্ধতার জন্য দীর্ঘদিন ধরে আবাদ করতে পারছি না। বারবার প্রশাসনের কাছে ধরনা দিয়ে কোন কাজ হচ্ছে না।" গন্ডবিল গ্রামের মো. বেলাল হোসেন বলেন, "জলাবদ্ধতার কারণে বাধ্য হয়ে আমিও পুকুর খনন করেছি। তবে খাল খনন করা হলে সকলের জন্যই উপকার হবে।"

এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা প্রীতম কুমার হোড় বলেন, " অবৈধভাবে পানি নিষ্কাশন খালের মুখে পুকুর খনন করায় বিলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। বিএডিসির সেচ প্রকল্প ও উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে স্থায়ীভাবে বিলের জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য কাজ করা হচ্ছে।"

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মেহেদি হাসান জানান, "জমির মালিক ও পুকুর মালিকের সাথে কথা বলে সাময়িকভাবে পানি নিষ্কাশনের একটি ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য কথা বলা হয়েছে। এছাড়া স্থায়ী সমস্যা সমাধানের জন্য বিএডিসির সেচ প্রকল্পে একটি প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে স্থায়ীভাবে জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধান হবে।"

এ সম্পর্কিত আরও খবর