দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও সুনাম ছিল সোনালী আঁশ খ্যাত পাটের। রংপুর অঞ্চলের উৎপাদিত পাট দিয়ে তৈরি হতো কাপড়, শতরঞ্জি, পাপোশ, ব্যাগ, বস্তা, বিভিন্ন জিনিসপত্র। বিশেষ করে নারীদের সূক্ষ্ম হাতের নিপুণ ছোঁয়ায় মনের মাধুরী মিশিয়ে তৈরি করা জিনিসগুলো নজর কাড়ত যে কারো। একটা সময় দেশব্যাপী সাড়া পাওয়ায় পাটের ব্যাপক চাহিদায় ভাগ্য বদলায় এই অঞ্চলের কৃষকদের।
তবে বাজারে পলিথিনের আগমনে তখন থেকেই পাটের জগতে নেমে আসে অন্ধকার। এতে ন্যায্য দাম না পাওয়ায় কমতে থাকে চাষ ও পাট চাষির সংখ্যা। পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে আবারো ফিরতে পারে সোনালি আঁশের সুদিন, এমনটি মনে করছেন পাট চাষিরা।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, রংপুর নগরীর টার্মিনাল থেকে মডার্ন মোড় এলাকায় রাস্তার পাশেই দেখা মেলে কয়েকটি পাটের গোডাউনের। পাট ট্রাকে তুলতে ব্যস্ত শ্রমিকরা। পাটের চাহিদা বেড়েছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
পলিথিনমুক্ত দেশ গড়ার ঘোষণা চাষিদের মধ্যে নতুন স্বপ্ন জাগিয়েছে। এই সিদ্ধান্তে আবারও সুদিন ফেরাতে খুশি রংপুরের পাট চাষিরা। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পলিথিনের ব্যবহার কমলে পাট পণ্যের ব্যাপক চাহিদা বাড়বে। এতে করে অতীতের ন্যায় আবারও ন্যায্য মূল্য পাবেন কৃষকরা। পলিথিন ব্যবহার বন্ধে কঠোরতায় বিভিন্ন উদ্যোক্তা ও শহরের ছোট-বড় দোকানগুলোতে নজর কাড়ছে কাপড় কিংবা কাগজের ব্যাগ ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন ক্রেতারা।
আবহাওয়া অনুযায়ী পাট চাষের জন্য রংপুর অঞ্চলের মাটি, জমির ধরন বেশ উপযোগী। এই অঞ্চলের মাটিতে ও কৃষকদের পরিশ্রমে পাটের বাম্পার ফলন সম্ভব। আবারও উৎপাদন বাড়ালে দেশ-বিদেশে পাটের চাহিদা পূরণ সম্ভব বলে মনে করছে কৃষি বিভাগ।
সংশ্লিষ্ট দফতর সূত্রে জানা যায়, মৌসুমের শুরুতে কৃষকরা প্রতি মণ পাট ২ হাজার ৭০০ থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত দরে বিক্রি করতে পেরেছিলেন। বর্তমানে পাটের বাজার ৩ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ৩ হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত। তবে অনেকেই আরও বেশি দামের আশায় পাট মজুদ করেছেন। পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধের পাশাপাশি পাট চাষে আগ্রহ ও ন্যায্য দাম পেলেই পাট শিল্পকে ধরে রাখতে এবং কৃষকদের সুদিন ফেরানো সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা প্রকল্পের অধীনেই দুই মাস পর ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে শুরু হচ্ছে এর বাণিজ্যিক উৎপাদন। গত ২০ অক্টোবর এমন সিদ্ধান্তের ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন (বিজেএমসি)। এর উৎপাদন প্রযুক্তি-কৌশল ও উদ্যোক্তাদের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে চায় সংস্থাটি। এতে বাণিজ্যিকভাবে আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে সোনালি আঁশ।
রংপুর নগরীর দখিগঞ্জে এলাকার পাটচাষি তৈয়ব আলী বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘জন্মের পর হাতে দ্যাকোছি পাটের আবাদ সুবাদ করে বাপ- দাদায়। পাছে পাছে হামরায় হাল ধরি ক্ষ্যাতোত। পাট আবাদ করি দাম পাই না। সউগ কষ্ট হামার ব্যাফলে যায়। এইতন করি ধরি আছি পাট আবাদ। এল্যা যদি আগের নাকান আবার দাম পাওয়া যায়, পাটের চাহিদা থাকে বাজারোত তাইলেতো কষ্ট কমবে। অনেক কৃষক আবাদ ছাড়ছে দাম পায় না জইনতে। কোনো সুযোগ সুবিধা নাই, কৃষকের মরণ দশা! দাম পাইলে আবার ঘাস আবাদ বাদ দিয়া পাট আবাদ করমো।’
সোনালি আঁশে সুদিনের আশায় রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার কৃষক জিল্লুর রহমান বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘পাটের ন্যায্যমূল্য দিতে হবে। কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও পর্যাপ্ত প্রণোদনা দিতে হবে। পলিথিনমুক্ত দেশ গড়তে পাট চাষ বাড়াতে হবে। সেই সাথে বন্ধ পাটকলগুলোও চালু করতে হবে। এগুলো করা গেলে সোনালি আঁশের সুদিন ফিরবে। কৃষক লাভবান হলে ফের পাট চাষ শুরু করবে সবাই।’
এ বিষয়ে রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) কর্মকর্তা বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘চলতি মৌসুমে রংপুর কৃষি অঞ্চলের ৫টি জেলায় প্রায় ৫৪ হাজার হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল প্রায় ৬ লাখ ৬৬ হাজার ৫৪ বেল পাট। জেলাগুলো হলো রংপুর, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও লালমনিরহাট। রংপুর পাটের চাষের জন্য উপযোগী অঞ্চল। চাহিদার সাথে উৎপাদন বাড়লে পাটের সুদিন ফেরা সম্ভব।’