সিরিয়াল প্রতারকের খপ্পরে নারী ক্রিকেটাররা, অবশেষে ধরা

, জাতীয়

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2024-01-31 18:28:05

আল আমিন ওরফে আযান। এক সময়ে ছিলেন কাপড়ের দোকানের কর্মী। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিক্রয় কর্মীর কাজ করা আযান নিজেকে পরিচয় দিতে শুরু করেন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা। এই পরিচয় ব্যবহার করে ২০১৫ সাল থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, টিকটকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে নারীদের টার্গেট করে সম্পর্ক গড়ে তুলতেন। এরপর তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মুহুর্তের ছবি ভিডিও দিয়ে ব্ল্যাকমেইল আবার কখনো বিয়ে করে হাতিয়ে নিতেন টাকা পয়সাসহ সর্বস্ব। এরপর আত্মগোপনে গিয়ে বন্ধ করে দিতেন সকল যোগাযোগের পথ। 

তার এমন অভিনব প্রতারণার শিকার হলেন কয়েকজন নারী ক্রিকেটার। রাজধানীর রাজাবাজার থেকে জাতীয় দলের কয়েকজন নারী ক্রিকেটারের মালামাল চুরি করে পালিয়ে যাওয়ার পর গতকাল মঙ্গলবার রাতে র‌্যাব-১৩ ও র‌্যাব-২-এর যৌথ অভিযানে দিনাজপুর থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।

এ সময় তার কাছ থেকে ৪টি আইফোনসহ ৫টি মোবাইল ফোন, প্রাইম ব্যাংকের একটি চেক বইয়ের পাতা, প্রাইম ব্যাংকের একটি মাস্টার কার্ড, বেশকিছু বৈদেশিক মুদ্রা, ৩টি হাত ঘড়ি, ৪টি চেইন, ১টি নোজপিন, ১টি ব্রেসলেট, ২টি আংটি ও ১টি হ্যান্ড ব্যাগ উদ্ধার করা হয়।

বুধবার (৩১ জানুয়ারি) বিকেলে কারওয়ান বাজার র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এ তথ্য জানান।

তিনি বলেন, গত ২৯ জানুয়ারি রাজধানীর তেজকুনীপাড়া খেলাঘর মাঠে বাংলাদেশ জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের অলরাউন্ডার স্বর্ণা আক্তার ও তার সতীর্থ খেলোয়াড়দের সঙ্গে অনুশীলনকালে তার ব্যবহৃত দুটি আইফোন চুরি হয়। একইদিনে তার বাসা থেকে সাড়ে ৩ হাজার মার্কিন ডলার, ব্যাংকের চেক বই ও ভিসা কার্ডসহ মূল্যবান জিনিসপত্র চুরির ঘটনাও ঘটে।

এ ঘটনায় ক্রিকেটার স্বর্ণা আক্তার রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় একটি চুরির মামলা দায়ের করেন। ঘটনাটি ব্যাপক আলোচিত হয়। চুরির ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিকে গ্রেফতারের লক্ষ্যে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে র‌্যাব।

গ্রেফতার আযানকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে কমান্ডার মঈন বলেন, তিনি মূলত প্রতারণার টার্গেট নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন আইডি খুলে নিজেকে কখনো গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা, আবার কখনো বড় ব্যবসায়ী পরিচয় দিয়ে সুন্দরী নারীদের আকৃষ্ট করত। এজন্য সে নিয়মিত বিভিন্ন স্টাইলে ছবি পোস্ট করতো। এছাড়াও নিজেকে প্রদর্শনের জন্য টিকটক ভিডিও তৈরি করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপলোড করতো।

এভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সুন্দরী নারীদের সঙ্গে কৌশলে সম্পর্ক গড়ে তুলতো। পরবর্তীতে ওইসকল নারীকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে তাদের আস্থা অর্জন করে নিয়মিত তাদের সঙ্গে দেখা করতো। অনেক ক্ষেত্রে কোনো নারীকে বিয়ে করে বা বিয়ে না করে সুবিধাজনক সময়ে তাদের নগদ অর্থসহ মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে কৌশলে আত্মগোপনের জন্য অন্য এলাকায় অবস্থান করতো। এসময় তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রাখতে তার সংশ্লিষ্ট ফেসবুক আইডি ডিলেট করে দিতো। পরবর্তীতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে কিছুদিন পরে আবার সে কারো সঙ্গে প্রতারণার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আরেকটি আইডি খুলে একই কাজ করতো।

একই টার্গেট নিয়ে গ্রেফতার আল আমিন নিজেকে গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তার পরিচয় ও বর্তমানে ছুটিতে অবস্থান করে কাপড়ের ব্যবসা করছে বলে একজন নারী ক্রিকেটার সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচিত হয়। পরে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়। একপর্যায়ে পরিচয়ের ১৭ দিনের মাথায় গত ১২ জানুয়ারি গ্রেফতার আল আমিন ওই নারী ক্রিকেটারের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়।

জাতীয় ক্রিকেট দলের নারী অলরাউন্ডার স্বর্ণা আক্তারের সঙ্গে ওই নারী ক্রিকেটারসহ ৪ জন প্রায় তিন বছর ধরে রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজার একটি ফ্ল্যাটে বসবাস করে আসছিলেন। কৌশলে ওই নারী ক্রিকেটারকে বিয়ের সূত্র ধরে গ্রেফতার আল আমিন ওই ফ্ল্যাটে নতুন স্ত্রীকে নিয়ে একটি আলাদা রুমে বসবাস করতে থাকে। এসময় প্রতারণার জন্য সে তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলে এবং ব্যবসায়ীক বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে কৌশলে বিভিন্ন সময় তাদের কাছ থেকে পরিশোধের আশ্বাস দিয়ে প্রায় দুই লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়।

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গত ২৯ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ৯টার দিকে জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের অলরাউন্ডার স্বর্ণা ও তার ৩ জন রুমমেটসহ সতীর্থ খেলোয়াড়দের নিয়ে রাজধানীর তেজকুনীপাড়া খেলাঘর মাঠে অনুশীলনে যান। এসময় গ্রেফতার আল-আমিন বাসায় অবস্থান করছিল। পরবর্তীতে পরিকল্পনা অনুযায়ী অলরাউন্ডার স্বর্ণার রুমের ওয়ারড্রবের ড্রয়ারের তালা ভেঙ্গে ডলার, ১টি চেক বই, ভিসা কার্ড, তার রুমমেট অন্য নারী ক্রিকেটারের ব্যাগ থেকে সাড়ে ৬ হাজার টাকা ও তাদের ব্যবহৃত ব্যাগ করে নিয়ে বাসা থেকে বেড়িয়ে তেজকুনীপাড়া খেলাঘর মাঠে আসে। এসময় তাদের অনুশীলনের ভিডিও করার কথা বলে অলরাউন্ডার স্বর্ণা আক্তারের ব্যবহৃত আইফোন দুইটি ব্যাগ থেকে নিয়ে কিছুক্ষণ ছবি তুলে কৌশলে মাঠ থেকে পালিয়ে যায়। 

পরবর্তীতে গ্রেফতারকৃত আল আমিন স্বর্ণা আক্তারের ব্যবহৃত একটি আইফোন রাজধানীর একটি পুরাতন মালামাল বিক্রির মার্কেটে ১১ হাজার টাকায় বিক্রি করে বাসযোগে দিনাজপুরের উদ্দেশ্যে ঢাকা থেকে প্রথমে রংপুর গিয়ে রাতে হোটেলে অবস্থান করে। পরেরদিন রংপুর থেকে দিনাজপুর হোটেলে অবস্থান করে। অনুশীলন শেষে স্বর্ণা আক্তার গ্রেফতার আল আমিনকে দেখতে না পেয়ে অন্য নারী ক্রিকেটারের মোবাইল থেকে ব্যবহৃত মোবাইল দুটিতে ফোন করলে ফোন দুইটি বন্ধ পায়। পরবর্তীতে তারা বাসায় ফিরে ফ্লাটের মূল দরজা লক করা অবস্থায় খেতে পায়। এসময় বাসার দারোয়ানের সহযোগিতায় তালা ভেঙ্গে বাসার ভেতরে প্রবেশ করে রুমের সমস্ত জিনিসপত্র এলামেলো অবস্থায় দেখতে পায়।

র‍্যাবের মুখপাত্র আরও বলেন, গ্রেফতার আল-আমিন ২০১১ সালে রাজধানীর একটি স্কুল থেকে এসএসসি সম্পন্ন করেছে বলে জানায়। সে ইতোপূর্বে রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেটে কাপড়ের দোকানে চাকরি করতো। পরবর্তীতে ২০১৬/২০১৭ সাল থেকে নারীদের সঙ্গে প্রতারণাসহ অনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করা ও বিভিন্ন ধরণের প্রতারণা করতে থাকে। প্রতারণার পর পার্শ্ববর্তী দেশে আত্মগোপনে চলে যেতো। সে ২০২২ সালে প্রথম বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। এর আগে বেশ কয়েকজন নারীর সঙ্গে তার প্রতারণা করার বিষয়ে প্রথম স্ত্রী জানতে পারলে তাদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। এ ঘটনার পর সে এবারও পার্শ্ববর্তী দেশে পালিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রাজধানী ঢাকা থেকে রংপুর হয়ে দিনাজপুরে আত্মগোপন করে। পরবর্তীতে আত্মগোপনে থাকাবস্থায় র‌্যাব কর্তৃক গ্রেফতার হয়।

তার বিরুদ্ধে রাজধানী ঢাকা ও চাঁদপুরের বিভিন্ন থানায় ৪টির বেশি মামলা রয়েছে এবং এসব মামলায় সে তিনবার বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করেছেন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর