আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গে হতে চলেছে অতিগুরুত্বপূর্ণ উপনির্বাচন। সোমবারই (২৭ সেপ্টেম্বর) ছিল প্রচারের শেষদিন। রাজ্যের ৭ কেন্দ্রে উপনির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও ওই দিন নির্বাচন হবে দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুর, মুর্শিদাবাদ জেলার সামশেরগঞ্জ ও জঙ্গিপুরে। তবে ৩ কেন্দ্রের মধ্যে সবার চোখ থাকবে ভবানীপুরে। কারণ আগামীতে মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে থাকতে হলে ভবানীপুরের উপনির্বাচন জিততেই হবে তৃণমূল প্রার্থী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। ফলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে এবারের উপনির্বাচন হলো এক প্রেস্টিজ ফাইট।
মূলত, আটটি ওয়ার্ড নিয়ে তৈরি ভবানীপুর বিধানসভা কেন্দ্রজুড়ে একাধিক ভাষার মানুষের বসবাস। ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ এসে থাকেন এখানে। আর এই ভিন্ন প্রান্তের মানুষ এই বিধানসভা কেন্দ্রের ভোটার। এখানকার ৬২ শতাংশ ভোটার অবাঙালি। ফলে পশ্চিমবঙ্গের নিরিখে এই কেন্দ্রটিকে ‘মিনি ইন্ডিয়া’ বলা হয়ে থাকে। অপরদিকে বিজেপি চাইছে নন্দীগ্রামের ফলাফল পুনরাবৃত্তি ঘটাতে। ফলে অনেক অংক কষে এই কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী অবাঙালি প্রিয়াঙ্কা টিব্রেওয়াল।
তবে মমতার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে ভবানীপুর তাকে কোনদিন নিরাশ করেনি। ২০১১ সালে বিধানসভা ভোটে জিতে প্রথমবার মুখ্যমন্ত্রী হন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সময়ে তিনি ছিলেন সংসদ সদস্য। ফলে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর উপনির্বাচনে লড়তে হয়েছিল তৃণমূল নেত্রীকে। ভবানীপুর কেন্দ্রটিকেই বেছে নিয়েছিলেন মমতা। প্রথমবার বিধানসভা নির্বাচনে লড়ে বিপুল ভোটে জয়ী হন তিনি। সেইবার মমতার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন সিপিএম প্রার্থী নন্দিনী মুখোপাধ্যায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পান ৭৩,৬৩৫ ভোট। আর নন্দিনী মুখোপাধ্যায় পান ১৯,৪২২ ভোট। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৫৪ হাজার ২১৩ ভোটে জয়ী হন। বিজেপি প্রার্থী রামচন্দ্র জয়সওয়াল পেয়েছিলেন মাত্র ৫,০৭৮টি ভোট।
এরপর ২০১৬-তেও ভবানীপুর বিধানসভা ভোটেও কেন্দ্র থেকেই প্রার্থী হন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেবার তিনি পেয়েছিলেন ৬৫ হাজার ৫২০ ভোট। কংগ্রেস প্রার্থী ছিলেন দীপা দাশমুন্সি। তাঁকে ২৫ হাজার ৩০১ ভোটে হারিয়েছিলেন মমতা। দীপা দাশমুন্সি পেয়েছিলেন ৪০,২১৯টি ভোট। বিজেপির টিকিটে দাঁড়িয়েছিলেন নেতাজির প্রপৌত্র চন্দ্রকুমার বসু। তিনি পেয়েছিলেন ২৬ হাজার ২৯৯ ভোট। বিজেপির ভোট প্রায় ১৫ শতাংশ বেড়েছিল। ওই বছর থেকেই পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির উত্থান শুরু হতে থাকে।
এরপর ২০২১-এর বিধানসভা ভোটে নন্দীগ্রামে প্রার্থী হন তিনি। তাঁর জায়গায় ভবানীপুর থেকে তৃণমূল দাঁড় করায় শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়কে। শোভনদেব পান মোট ৭৩ হাজার ৫০৫ ভোট। একুশের ভোটে এই কেন্দ্রে অভিনেতা রুদ্রনীল ঘোষকে প্রার্থী করে চমক দিয়েছিল বিজেপি। তবে রুদ্রর ঝুলিতে যায় ৪৪,৭৮৬ ভোট। শোভনবাবু রুদ্রনীলকে হারান প্রায় ২৭,৯৮০ ভোটে। সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী কংগ্রেসের সাদাব খান পান মাত্র ৫২১১ ভোট। বিজেপি পায় ৩৫.১৬ শতাংশ ভোট।
তবে একুশের বিধানসভা ভোটের মাঝেই ২০১৯ সালে ভারতে হয়ে যায় লোকসভা ভোট। মোদি ঝড়ে খড়কুটোর মতো উড়ে যায় বিরোধীরা। দ্বিতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হোন নরেন্দ্র মোদি। সেই ঝড় আছড়ে পড়েছিল পশ্চিমবাংলাতে। রাজ্যের ৪২টি আসনের মধ্যে ১৮ আসন পায় বিজেপি। স্বভাবতই এর প্রভাব পড়েছিল ভবানীপুর বিধানসভা কেন্দ্র। সাতটি বিধানসভা কেন্দ্র নিয়ে তৈরি 'দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা কেন্দ্র' এর প্রার্থী হন তৃণমূলের সুব্রত বক্সী। এর মধ্যেই পড়ে ভবানীপুর বিধানসভা কেন্দ্র। তৃণমুল এই আসনটি ধরে রাখতে পারলেও ভবানীপুর হাতছাড়া হয়েছিল।
ফলে ‘মিনি ইন্ডিয়া’ অর্থাৎ ভবানীপুর বিধানসভা কেন্দ্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে যেমন নিরাশ করেনি তেমনি কলকাতার নিরিখে এই কেন্দ্রটি সব সময় বাড়তি অক্সিজেন দেয় বিজেপিকে। প্রচারে শেষদিনে এখন তাই কাগজে-কলমে অংক মেলানো কাজ শুরু হয়েছে।
সম্প্রতি মমতা বন্দোপাধ্যায় নিজেই বলেছেন, আসল চ্যালেঞ্জ ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন। মূলত এই নির্বাচনে মোদি বিরোধী কংগ্রেস-সহ সকল রাজনৈতিক দলকে একত্রিত করছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফলে ভবানীপুর ভোট অর্থাৎ মিনি ইন্ডিয়ার উপনির্বাচন থেকেই গোটা ভারতের মানুষের মন বুঝে নিতে চায় তৃণমূল কংগ্রেস। আর সে কারণেই এই উপনির্বাচনের দিকে শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, তাকিয়ে আছে গোটা ভারত। ভোটের ফলাফল ৩ অক্টোবর।