১৯৪৬ সালের আগস্টে ‘গ্রেট কলকাতা কিলিং’ হয়েছিল যে শহরে, সে শহর ভারতের ‘নিরাপদতম’ শহর এখন। ঔপনিবেশিক ইংরেজরা শহরটিকে ‘দ্বিতীয় লন্ডন’ বানাতে চাইলেও সে শহর হয়ে উঠেছিল রক্ত ও বিভাজনের আঁতুড়ঘর। বাংলা ভাগের সঙ্গে মিশে আছে এই শহরের দাঙ্গা, হাঙ্গামা, সাম্প্রদায়িক বিভেদের ইতিহাস। সেইসব রক্তস্মৃতি এবং পরবর্তীতে দিল্লি, মুম্বাই, চেন্নাই, বেঙ্গালোরের রোমহর্ষক ধর্ষণ ও নারী নিগ্রহের বিরুদ্ধে নিরাপত্তার বাতাবরণ তৈরি করেছে কলকাতা। একবার নয়, পরপর দুইবছর ভারতের নিরাপদতম শহরের শীর্ষে স্থান পেলো কলকাতা।
অপরাধের নিরিখে ভারতের ১৯টি মেট্রো শহরের মধ্যে ‘নিরাপদতম’ হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের রাজধানী কলকাতা। ভারতের জাতীয় ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো (এনসিআরবি) প্রণীত রিপোর্টে বলা হয়েছে, অপরাধ-সহ মহিলাদের বিরুদ্ধে নানান অপমানজনক ঘটনায় সবচেয়ে নিরাপদ কলকাতা।
এনসিআরবি গত এক বছরের অপরাধের একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। ‘ক্রাইম ইন ইন্ডিয়া, ২০২০’ শীর্ষক সেই ভলিউমে দেখা যাচ্ছে, ২০২০ সালে প্রত্যেক লাখ জনসংখ্যায় কলকাতায় মোট অপরাধের হার ১২৯.৫। যেখানে চেন্নাইয়ে অপরাধের হার সবচেয়ে বেশি ১৯৩৭.১। দিল্লিতে ১৬০৮.৬, আহমেদাবাদে ১৩০০, বেঙ্গালোরে ৪০১.৯ এবং মুম্বইয়ে ৩১৮.৬।
গত দু’বছরের তুলনায় সামগ্রিক ভাবে নথিভুক্ত অপরাধের সংখ্যাও কমেছে কলকাতায়। ২০১৮ সালে কলকাতায় অপরাধের সংখ্যা ছিল ১৯,৬৮২। ২০১৯-এ সেই সংখ্যা কমে হয়েছিল ১৭,৩২৪। তার পর ২০২০ সালে শহরে মোট অপরাধের সংখ্যা আরও কমে হয়েছে ১৫,৫১৭।
পরিসংখ্যান আরও বলছে, মেয়েদের বিরুদ্ধে হওয়া নারীঘটিত অপরাধের সংখ্যাতেও দিল্লি, মুম্বই, বেঙ্গালোর থেকে অন্যতম নিরাপদ কলকাতা শহর। গত এক বছরে কলকাতায় মেয়েদের বিরুদ্ধে অপরাধের সংখ্যা ২,০০১। দেশের রাজধানী দিল্লিতে ৯,৭৮২। প্রসঙ্গত, দিল্লির আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ভার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে। ধর্ষণ এবং পণ না দেওয়ায় মৃত্যুর ঘটনাতেও দিল্লি, বেঙ্গালোর এবং মুম্বইয়ের থেকে পিছিয়ে রয়েছে কলকাতা। ফলে সর্বভারতীয় স্তরে কলকাতার গৌরব মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইমেজকে আরও উজ্জ্বল করবে এবং জাতীয় রাজনীতিতে তাঁর ক্রমউত্থানকেও মসৃণ করবে।
তবে, অবিভক্ত বাংলার মানুষের প্রাচীন স্মৃতির শহর কলকাতা একালের প্রজন্মের কাছেও পছন্দের। কলকাতার ব্যবসা, পর্যটন, স্বাস্থ্যখাত বহুলাংশে নির্ভরশীল বাংলাদেশিদের ওপর। মধ্য কলকাতার নিউমার্কেট, তালতলা, ধর্মতলায় গেলেই বাংলাদেশি পর্যটকদের বিপুল উপস্থিতি চাক্ষুষ দেখা যায়। আরও দেখা যায় পুরনো শহরের নস্টালজিক আভা।
প্রায়ই কলকাতা গেলে এসপ্ল্যানেড রো ইস্ট থেকে আনমনে হাঁটা শুরু করি আমি। এখন রাস্তাটি সিধু কানহু ডহর নামে পরিচিত। তারপর চলে যাই চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ। পুরোনো কলকাতার অভিজাত এলাকা। একের পর এক প্রখ্যাত বাঙালি পরিবার এখানে বসতবাড়ি গড়ে তুলেছিলেন একদা। বেশিরভাগ প্রাসাদ আজও দেখতে পাওয়া যায়। এসপ্ল্যানেড রো জুড়ে ব্রিটিশরা তৈরি করেন রাজকীয় সব অফিস ভবন। যার মধ্যে কয়েকটি ভারত সরকার অধিগ্রহণ করে নিয়েছে।
অফিসগুলোর পাশ দিয়ে চলে গিয়েছে ডেকার্স লেন, যা কলকাতার স্ট্রিট ফুডের স্বর্গরাজ্য। ১৭৭৩ সালের দিকে কলকাতার কালেক্টর এবং ১৭৭৭ থেকে ৮৪ পর্যন্ত বোর্ড অফ ট্রেডের সভাপতি ছিলেন ফিলিপ ডেকার্স। তাঁর নামেই রাস্তা। রাস্তাটির নাম পালটে এখন জন অগাস্টাস হিকির নামে রাখা হয়েছে। ১৭৮০ সালে যিনি ‘হিকি’স গেজেট’ প্রকাশ শুরু করেন। সম্ভবত ভারতের প্রথম মুদ্রিত খবরের কাগজ সেটি।
এসপ্ল্যানেডে জংশনে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক পুরোনো ও আইকনিক স্থাপত্য 'টিপু সুলতান মসজিদ', যা গড়ে তোলেন মহীশূরের শাসক টিপু সুলতানের ছোট ছেলে প্রিন্স গোলাম মুহম্মদ শাহ। দক্ষিণ ভারত থেকে তাঁদের পরিবার কলকাতায় চলে আসে ১৮০৬ সালের পর। মসজিদ নির্মাণ সম্পূর্ণ হয় ১৮৪২ সালে। মাঝারি আকারের ধর্মীয় স্থান। চারদিকে ঘিরে আছে খাবারের স্টল এবং স্টেশনারি দোকান। ভালো করে দেখলে চোখে পড়বে মসজিদের উঠোনে একটি মার্বেল ফলক। লেখা আছে, ১৮৭৫ সালে প্রিন্স অফ ওয়েলসের কলকাতা আগমন উপলক্ষে এই মঞ্চ তৈরি করেন ঢাকার নবাব আসানুল্লাহ খান।
মসজিদের ঠিক উল্টোদিকে লেনিন সরণিতে রয়েছে চার্চ অফ দ্য সেক্রেড হার্ট। ঠিক কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, জানা যায় না। তবে প্রবেশদ্বারের কাছে থাকা দুটি স্মৃতিফলক দেখে অনুমান করা হয়, ১৮৫০-এর দশকে গড়ে উঠেছিল। ভিতরের দৃশ্য খুবই সুন্দর। মুগ্ধ করবে রঙিন কাচের জানলা এবং থামের কারুকার্য।
এসপ্ল্যানেড ক্রসিং থেকে ডানদিকে ঘুরলেই চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ। প্রথমেই চোখে পড়বে স্টেটসম্যান হাউজ – কলকাতার সবচেয়ে পুরোনো সংবাদপত্রের অফিস। যদিও এখন সেই গরিমা আর নেই। তা সত্ত্বেও বলা যেতে পারে, তিলোত্তমার সঙ্গেই বেড়ে উঠেছে স্টেটসম্যানের ইতিহাস। বাড়িটির মেরামত হয়নি অনেকদিন। বিশাল ব্যালকনি, বড়ো বড়ো থাম এবং মোহময় খিলান দেখে পুরোনো দিনের মর্যাদা অনুমান করা যায়। কলকাতার ভূতুড়ে বাড়িগুলোর মধ্যেও এটি অন্যতম।
উল্টোদিকে রয়েছে ভিক্টোরিয়া হাউজ। বর্তমানে সিইএসসি হাউজ, ক্যালকাটা ইলেকট্রিক সাপ্লাই করপোরেশনের দফতর। সিইএসসি-র প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ইংল্যান্ডে ১৮৯৬ সালে, যা কলকাতা ছাড়াও আশেপাশের অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে এখন। দানবীয় বাড়িটার ছাদের ওপরে থাকা গ্লোবে রাত্রিবেলা আলো জ্বলে। দূর থেকে দেখা যায়।
কলকাতার এসব এলাকা ছুঁয়ে ছুঁয়ে নানা দিকে পথ চলে গেছে। উত্তরে বড়বাজার, চিৎপুর, কলেজ স্ট্রিট, শোভাবাজার, জোড়াসাঁকো, হাতিবাগান, বাগবাজার, শ্যামবাজার হয়ে বিটি রোড ধরে আরও উত্তরে সিঁথি, ডানলপ, কামারহাটি, বেলঘড়িয়া, খড়দহ, ব্যারাকপুর।
দক্ষিণে ময়দান পেরিয়ে ভবানীপুর, কালিঘাট, টালিগঞ্জ, আলীপুর, বেহালা, গড়িয়া হয়ে আরও দক্ষিণে বারুইপুর।
পূর্বের পথ রাজাবাজার, কাঁকরগাছি, ফুলবাগান, শিয়ালদহ, পার্ক সার্কাস, তিলজলা, বেলেঘাটা, তপসিয়া হয়ে বাগুইআটি, নিউটাউন, সল্টলেক। পশ্চিমের পথ হাওড়া ব্রিজ পেরিয়ে নদীর ওপারে বহুদূর।
কলকাতার সড়ক, পাড়া, মহল্লা, কেন্দ্রস্থল ও প্রান্তে প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে ইতিহাসের বহু আখ্যান। শতাব্দী প্রাচীন এমনই বহু সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক উত্থান-পতন পেরিয়ে নিরাপদতম শহরে উত্তীর্ণ হয়ে শুধু ভারত নয়, সমগ্র উপমহাদেশের মধ্যেই একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে কলকাতা।