ইসলামি রীতি-নীতি অনুযায়ী নারী-পুরুষের মাঝে ইজাব-কবুলের মাধ্যমে যে সম্পর্কের সেতুবন্ধন তৈরি হয়- সেটাই বিয়ে। পৃথিবীতে প্রথম আত্মীয়তার বন্ধনের সূচনা ঘটে বিয়ের মাধ্যমে। হজরত আদম আলাইহিস সালাম আর হজরত হাওয়া আলাইহিস সালামের মাঝে এই বন্ধন স্থাপিত হয়। তখন অন্যকোনো আত্মীয় ছিলো না। দুনিয়ায়ও শেষ সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীকেন্দ্রিকই থাকে। ছেলে-মেয়ে সবাই যার যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায়। জান্নাতের মাঝেও স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কই বহাল থাকবে।
কোরআনে কারিমে আল্লাহতায়ালা তার বিভিন্ন সৃষ্টিকে আল্লাহর বড় নিদর্শন বলে আখ্যায়িত করেছেন। সবার কাছে এগুলো আল্লাহর বড় নিদর্শন। যেমন আল্লাহতায়ালা আসমান-জমিন সৃষ্টিকে আল্লাহর বড় নিদর্শন বলেছেন, এমনিভাবে রাতে নিদ্রা যাওয়া, বিশালাকারের পাহাড়-পর্বত সৃষ্টি এসবও আল্লাহর সৃষ্টির বড় নিদর্শন।
সূরা আশ-শুরার ৩২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘সমুদ্রে ভাসমান পর্বতসম জাহাজসমূহ তার অন্যতম নিদর্শন।’ এগুলো আল্লাহর নিদর্শন যা দেখলে মানুষের ঈমানে তরঙ্গ উঠে। এই নিদর্শনাবলীর মাঝে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে আল্লাহর বড় নিদর্শন বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন এত বড় নিদর্শন কীভাবে হলো- যাকে আল্লাহতায়ালা পাহাড় পর্বত, আসমান-জমিন সৃষ্টির সঙ্গে উল্লেখ করেছেন? অন্যকোনো আত্মীয়তার বন্ধনকে আল্লাহ বড় নিদর্শনাবলীর মাঝে অন্তর্ভুক্ত করেননি। চাই সেটা মা-বাবা কিংবা অন্যকোনো রক্তের বাঁধন হোক। কোরআনে আল্লাহতায়ালা স্বামী-স্ত্রী নিয়ে যতগুলো আয়াত অবতীর্ণ করেছেন, অন্যকোনো আত্মীয়-স্বজন নিয়ে নাজিল করেননি। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক হচ্ছে পরিবারের মূল স্তম্ভ। তাদের সম্পর্ক যত মধুর হবে, ততই সংসারে সুখ আর শান্তির বাতাস বইবে। এই বৃক্ষের ছায়াতলে থেকে সন্তান-সন্ততি আদর্শবান হবে। আর যদি এর ব্যতিক্রম হয় অর্থাৎ তাদের সম্পর্কে চির ধরে তাহলে এর ক্ষতি ও অশান্তির আগুন পুরো পরিবারকে ধ্বংস করে দেবে। পৃথিবীতে কোনো আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন হয় না, একমাত্র স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন ছাড়া। এ বন্ধন একটি কথার মাধ্যমেই ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। একদিকে এই সম্পর্কটি যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি স্পর্শকাতরও বটে।
তাই আল্লাহতায়ালা স্বামী-স্ত্রীর বন্ধনকে তার বড় নিদর্শনাবলী বলেছেন। সূরা রোমের ২১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আর এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সংগিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাকো এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয়ই এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্যে নিদর্শনাবলি রয়েছে।’
আয়াতে আল্লাহতায়ালা কয়েকটি শব্দ বলেছেন-
এক. ‘লিতাসকুনু’ অর্থ প্রশান্তি, অর্থাৎ তোমাদের কাছে পৌঁছে পুরুষ প্রশান্তি লাভ করবে। এ কারণেই তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আমাদের স্বজাতি থেকে আমাদের জন্য স্ত্রীর ব্যবস্থা করেছেন। যাতে আমাদের মধ্যে প্রশান্তি ও সুখ বিরাজ করে। কারণ, প্রত্যেক জীব কেবল স্বজাতির কাছেই নৈকট্য লাভ করে ও শান্তি খুঁজে পায়। যেমন অন্য আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘তিনিই তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন ও তার থেকে তার স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন, যাতে সে তার কাছে শান্তি পায়।’ -সূরা আল আরাফ: ১৮৯
দুই. ‘মাওয়াদ্দাহ’ এর অর্থ হলো- স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সুমধুর ভালোবাসা। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে যেরূপ ভালোবাসা সৃষ্টি হয় অনুরূপ ভালোবাসা পৃথিবীর অন্যকোনো মানুষের মাঝে হয় না। যা আল্লাহর রাসূল তার এক হাদিসে বর্ণনা করেছেন এভাবে, হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘দু’জনের পারস্পরিক ভালোবাসা স্থাপনের জন্য বিয়ের বিকল্প নেই।’ -ইবনে মাজাহ: ১৮৪৬
তিন. ‘রাহমাহ’ (মায়া-মমতা)। এটা স্বামী স্ত্রীকে সর্বপ্রকার সুখ-সুবিধা ও আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা করেন। অনুরূপভাবে স্ত্রীও নিজের সাধ্য ও ক্ষমতা অনুযায়ী স্বামীর সেবা করেন। মহান আল্লাহ উভয়ের ওপরই কিছু দায়িত্ব ন্যস্ত করেছেন। বলাবাহুল্য, মানুষ এমন প্রশান্তি ও অগাধ প্রেম-ভালোবাসা দাম্পত্যের মাধ্যমে লাভ করতে পারেন। যে সম্পর্কের ভিত্তি শরিয়তসম্মত বিয়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত।
শরিয়ত বিরোধী দাম্পত্যের কোনো সম্পর্ককে ইসলাম স্বীকার করে না। বরং তাদেরকে ব্যভিচারী আখ্যায়িত করে এবং তাদের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান দিয়েছে। কোনো কোনো দেশে আইন দ্বারা বিষয়টি সিদ্ধ করা হলেও শরিয়তে ইসলামে তা সিদ্ধ নয়।
বস্তুত একটি ভালোবাসাময় সুখী বৈবাহিক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য সবার মধ্যে যে গুণটি থাকা প্রয়োজন তা হলো- আন্তরিকতা। আন্তরিক বলতে মানুষটিকে হতে হবে বিনীত, নমনীয়, বিশ্বাসযোগ্য, ভালো স্বভাবের, সহযোগিতা মনোভাবাপন্ন, ক্ষমাশীল, উদার ও ধৈর্যশীল। এটা শুধু পুরষকে কিংবা নারীকে নির্দিষ্ট করে নয়- এ গুণ সবার থাকা উচিৎ। এটাই ইসলামের চাওয়া।
মুফতি জাওয়াদ তাহের: সিনিয়র শিক্ষক, জামিয়া বাবুস সালাম, বিমানবন্দর, ঢাকা-১২৩০