বিয়ের পরে নানা কারণে অনেক দম্পতির মধ্যে দেখা দেয় নানাবিধ সমস্যা। এর প্রেক্ষিতে বিয়ের পর বিচ্ছেদ হয়ে যায়। আর এই প্রবণতা দিনে দিনে বাড়ছে। বিবাহ বিচ্ছেদের কারণগুলোর অন্যতম হলো- যৌতুক, শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন, সন্দেহ, ভিন্ন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া, শারীরিক দুর্বলতা, প্রত্যাশা পূরণের অভাব, পরিবারের সদস্যদের অনধিকার চর্চা, ধৈর্যের অভাব ও ক্যারিয়ার নিয়ে সমস্যা।
সম্প্রতি সহযোগী এক দৈনিকের রিপোর্টে বিবাহ বিচ্ছেদ নিয়ে কিছু পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়েছে। যা রীতিমতো উদ্বেগ জাগানিয়া। ওই রিপোর্টের পক্ষে-বিপক্ষে নানাজনের নানামত থাকতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো- বর্তমান সময়ে বিবাহ বিচ্ছেদের হার বাড়ছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
বলছিলাম বিবাহ বিচ্ছেদ নিয়ে সহযোগী এক দৈনিকের রিপোর্টের কথা। একজন মুফতি হিসেবে প্রায় ১৮ বছরের কর্ম জীবনে প্রতিনিয়ত এই সমস্যার কথা শুনে আসছি। মানুষ লিখিতভাবে, ফোনে কিংবা সাক্ষাতে যে পরিমাণ মাসয়ালা জানতে চান- তার সিংহভাগই বিবাহ বিচ্ছেদ সংক্রান্ত। এর দ্বারা বুঝা যায়, বিবাহ বিচ্ছেদের প্রবণতা সমাজে কতটা প্রকট আকার ধারণ করেছে। এমন প্রবণতা পরিবারের সুরক্ষাকে নষ্ট করে দেয়, বিধিবদ্ধ সমাজ ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং সামাজিক বন্ধনকে শিথিল করে দেয়। যা মুসলিম সমাজের জন্য খুবই দুঃখজনক ও আশঙ্কাজনক।
প্রশ্ন হলো, সমাজে বিচ্ছেদ প্রবণতা কেন বাড়ছে? এটা নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীরা নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নানা কারণ বর্ণনা করেছেন। তবে যে কথাটি প্রায় সবাই বলছেন, তা হচ্ছে- ধর্মীয় অনুশাসনের অভাব। আমরা মনে করি, বাস্তবে এটাই সবচেয়ে বড় কারণ।
বিবাহ বিচ্ছেদের চিহ্নিত কারণগুলোর সঙ্গে ধর্মীয় অনুশাসনের বিষয়টি গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। এগুলো মানা হয় না বিধায়, বিচ্ছেদের মতো দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। যেমন- যৌতুক, শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন, অহেতুক সন্দেহ এবং ভিন্ন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া- ইসলামে এর সবগুলোই কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কিন্তু এগুলো সমাজে ঘটছে। অন্যদিকে শারীরিক দুর্বলতা থাকলে তাকে ইসলাম বিয়ে করার অনুমতি দেয়নি।
বাকী রইল- প্রত্যাশা পূরণের অভাব, পরিবারের সদস্যদের অনধিকার চর্চা, ধৈর্যের অভাব ও ক্যারিয়ার নিয়ে সমস্যা। এগুলো আপেক্ষিক বিষয়। ইসলাম মনে করে, স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক, একে অপরের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা, বিনয় ও ছাড়ের মানসিকতা- থাকলে বর্ণিত সমস্যা উতরে যাওয়া অসম্ভব নয়। আর এসবও কিন্তু ধর্মীয় অনুশাসনের অন্তর্ভুক্ত।
বস্তুত ইসলাম যে সুসংহত জীবন ব্যবস্থার কথা বলে, তার প্রতিটি অংশই অতি প্রয়োজনীয়। যে অংশই বাদ দেওয়া হবে, তার কুফল ভুগতে হবে। ইসলামে আয়-উপার্জন, জীবনমান ও জীবনধারার ক্ষেত্রে অল্পেতুষ্টির শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। জীবনের বাস্তব প্রয়োজন আর অবাস্তব প্রয়োজনের মাঝে রেখা টেনে দেওয়া হয়েছে। এখন অল্পেতুষ্টির পরিবর্তে যদি সম্পদ ও প্রাচুর্যের মোহ তৈরি হয়, বাস্তব প্রয়োজন ছাড়া নানা অবাস্তব প্রয়োজনের ভার কাঁধে তুলে নেওয়া হয়; তখন অস্থিরতা সৃষ্টি হওয়া খুবই স্বাভাবিক বিষয়।
তদ্রূপ ইসলামি শিক্ষায় পারস্পরিক অধিকার রক্ষার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একে অপরকে কোনোভাবেই কষ্ট না দেওয়া, প্রত্যেকে অন্যের অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট থাকা ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিধান। ইসলাম শুধু অধিকারের কথা বলে না, কর্তব্যের কথাও বলে। স্বামী ও স্ত্রী প্রত্যেকেরই রয়েছে কর্তব্য এবং অধিকার। নিজের কর্তব্য পালন আর অন্যের অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট হলেই কেবল সংসারে শান্তি আসতে পারে।
এ বিষয়ে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর স্ত্রীদেরও ন্যায়সঙ্গত অধিকার রয়েছে, যেমন তাদের প্রতি (স্বামীদের) অধিকার রয়েছে।’ -সূরা বাকারা: ২২৮
কাজেই দেখা যাচ্ছে, সংসার জীবনে নারীর যেমন কর্তব্য আছে, তেমনি অধিকারও আছে। একই কথা পুরুষের ক্ষেত্রেও। তাই পারিবারিক শান্তি-শৃঙ্খলার জন্য স্বামী-স্ত্রী উভয়কে নিজ নিজ কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং একে অপরের অধিকারের বিষয়ে শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।
এখানে একটি পরিষ্কার করা দরকার, সেটা হলো- ইসলামি শরিয়তে অতীব প্রয়োজনের ক্ষেত্রে বিচ্ছেদের অবকাশ দিয়েছে। কিন্তু বিষয়টি পছন্দনীয় নয়। সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই বাণী বর্ণিত হয়েছে যে, ‘আল্লাহর কাছে সবচেয়ে অপ্রিয় হালাল হচ্ছে তালাক।’ -সুনানে ইবনে মাজাহ: ২০১৮
সাহাবি হজরত মুহারিব ইবনে দিছার রাযিয়াল্লাহু আনহুর সূত্রে অন্য এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহতায়ালা তার কাছে তালাকের চেয়ে অপ্রিয় কোনো কিছু হালাল করেননি।’ -সুনানে আবু দাউদ: ২১৭৭
কাজেই বিচ্ছেদের ব্যাপারে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। নারী-পুরুষ উভয়ের কর্তব্য বিচ্ছেদ থেকে দূরে থাকা। ইসলামি শরিয়তের নির্দেশনা হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত বৈবাহিক সম্পর্ক রক্ষায় প্রয়াসী হওয়া। বিবাহ বিচ্ছেদের পর্যায়টি হচ্ছে- সর্বশেষ পর্যায়। যা একান্ত অনিবার্য প্রয়োজনের স্বার্থে বৈধ করা হয়েছে।
স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মনোমালিন্য হতে পারে, ঝগড়া-বিবাদ হতে পারে। তা নিজেরাই মিটমাট করে নেওয়া চাই। কিন্তু তা যদি বড় আকার ধারণ করে, তখন দুই পরিবার আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তির চেষ্টা করবে।
এ বিষয়ে কোরআনে নির্দেশনা দিয়ে বলা হয়েছে, ‘তাদের উভয়ের মধ্যে বিরোধ আশঙ্কা করলে তার (স্বামীর) পরিবার থেকে একজন ও তার (স্ত্রী) পরিবার থেকে একজন সালিস নিযুক্ত করবে। তারা উভয়ে নিষ্পত্তি চাইলে আল্লাহ তাদের মধ্যে মিমাংসার অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবিশেষ অবহিত।’ -সূরা আন নিসা: ৩৫
অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক জিদ ও বিদ্বেষের কারণে যখন আশঙ্কা হয় যে, তারা নিজেরা বিবাদ মিমাংসা করতে পারবে না; তখন দুই পক্ষের আত্মীয়দের মধ্য থেকে একজন একজন করে সালিশ নিযুক্ত করে দেওয়া হবে এবং মিমাংসার জন্য তাদেরকে স্বামী-স্ত্রীর কাছে পাঠানো হবে। আত্মীয়রাই তো তাদের অবস্থা ভালো জানবে এবং এদের কল্যাণকামিতার প্রত্যাশা তাদের কাছে বেশি করা যায়। এই দু’জন গিয়ে খোঁজখবর নেবে এবং যার যে পরিমাণ অন্যায় সে অনুযায়ী বুঝিয়ে শুনিয়ে তাদেরকে মিলিয়ে দেবে।
আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে, ‘উভয় সালিশ স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মিমাংসা করে দেওয়ার সদুদ্দেশ্য রাখলে আল্লাহতায়ালা তাদের নেক নিয়ত ও সঠিক চেষ্টার বদৌলতে বনিবনা করে দেবেন।’ কাজেই বিবাহ বিচ্ছেদের আগে এই কোরআনি শিক্ষার চর্চা ও অনুসরণ কাম্য।
বর্তমানে এই কোরআনি শিক্ষাটি অনেক ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত। দেখা যায়, ঝগড়া-বিবাদ বা মনোমালিন্য সৃষ্টি হলেই স্বামী বা স্ত্রী পক্ষ অথবা উভয় পক্ষের মধ্যে মিথ্যা আত্মমর্যাদাবোধ জাগ্রত হয় এবং কোনো এক পক্ষ তাড়াহুড়া করে বিচ্ছেদের পদক্ষেপ নিয়ে বসে। যা একেবারেই অনুচিত।
আমরা মুসলিম নারী-পুরুষদের বিনীত অনুরোধ করবো, তারা যেন বিবাহ বিচ্ছেদের আগে অন্ততঃ দশবার ভাবেন। সালিশ, সমঝোতাসহ যাবতীয় পূর্বপদক্ষেপ বিফলে গেলে যদি বিচ্ছেদের পথে যেতেই হয়; তবে কোনো নির্ভরযোগ্য আলেমের পরামর্শ নিয়ে তা করবেন। কোনো অবস্থাতেই এক তালাকে বায়েনের বেশি দেবেন না; যেন পরে সংসার পুনর্বহালের সুযোগ থাকে।