প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সংক্রমণকালে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রোববার (২৪ মে) ঘরবন্দি অবস্থায় অন্য রকম ঈদ উদযাপন করছেন মুসলমানরা। অন্যান্য বছরের ন্যায় এবার প্রবাসে ঈদের দিন দেশি-বিদেশিদের সঙ্গে কুশল বিনিময়, কোলাকুলি করা এবং এক শহর থেকে অন্য শহলে ঘুরে বেড়ানোর কোনো সুযোগ ছিলো না। প্রবাসে শুধু বাসা-বাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে উঁকি দিয়েই সময় কাটাতে হয়েছে। এক কথায়, প্রবাসীদের মাঝে বলতে গেলে ঈদ উদযাপনের কোনো আমেজই ছিলো না।
যদিও ঈদ, প্রিয়জন, উদযাপন- এই তিনটি শব্দ আমার কাছে একই সুতোয় বাঁধা মনে হয়। দূরদেশে এই প্রথম ঈুল ফিতর উদযাপন আমার। প্রিয় মানুষদের ছেড়ে পালন করতে হলো- এবারের নিরানন্দ ঈদ। তাও আবার রঙ-বর্ণহীন। ঈদের সেই চিরায়ত আমেজ পাবোই বা কী করে? সর্বত্রই তো রাজ করছে করোনা!
আমাদের মতো বিদেশ-বিভুঁইয়ে পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের সদা চেষ্টা থাকে ছুটিতে বাংলাদেশে যাওয়ার। দেশে গিয়ে ঈদের আমেজ উপভোগ করা। আপনজন বিশেষ করে বাবা-মা, ভাই-বোনসহ অন্য সব প্রিয়দের সঙ্গে ঈদানন্দে ভাগ বসানো। তাকবির বলতে বলতে ঈদের নামাজে অংশ নেওয়া, নামাজ শেষে পরস্পরে কুশল বিনিময়ের আনন্দের তৃপ্তি- অন্য কিছুতে মেলা ভার।
এবার করোনার মধ্য দিয়ে রমজান শুরু হয়েছে। সবাই ভেবেছিলো রমজানেই এই মহামারি কেটে যাবে। দুর্যোগময় সময়গুলোকে পেছনে ফেলে ঈদটি তার স্বভাবজাত আনন্দ দিয়ে ভরপুর থাকবে- এটাই ছিলো সবার প্রত্যাশ্যা। কিন্তু পরিস্থিতির তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি।
এশিয়ার উন্নত দেশ সৌদি আরবে নানা ধরনের সাবধানতার পরও করোনায় আক্রান্তদের সংখ্যা এখনও অনিয়ন্ত্রণে। তবে সুস্থদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি বেশ খুশির। এতো কিছুর পরও সিয়াম সাধনার মহিমান্বিত রমজান মাসটি আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহে ভালোভাবেই কেটেছে বলা চলে।
বিশ্ববিদ্যালয় এখন সম্পূর্ণ বন্ধ। করোনাময় মলিন এ পৃথিবীতে যখন ঈদ আসলো, তখন কাছের মানুষগুলো একে অপর হতে যোজন যোজন দূরে। দেশে গিয়ে নিজ পরিবারের সঙ্গে ঈদ উদযাপনের আগ্রহ কমবেশি সবারই ছিলো। কিন্তু বিমানপথ বন্ধ থাকায় সেটা আর হয়ে ওঠলো না। মক্কার পবিত্র শহর রমজানজুড়েই লকডাউন ছিলো। বাইরে বের হওয়ার ক্ষেত্রে ছিলো কড়া বিধিনিষেধ। রাষ্ট্রীয় আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে কেউই জনসমাগমে যায়নি।
গত দু’মাসেরও অধিক সময় ধরে সৌদি আরবের মসজিদগুলোতে জুমা-জামাত সাময়িকভাবে বন্ধ। মক্কার মসজিদে হারাম ও মদিনার মসজিদে নববীতে রমজানে সীমিত আকারে নামাজ-তারাবি চালু থাকলেও সাধারণদের প্রবেশে অনুমতি ছিলো না। প্রধান এই দুই মসজিদে সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রেখে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু সেখানেও সবার প্রবেশে অনুমতি ছিলো না। মসজিদে হারাম ও কাবার এতো নিকটে থাকা সত্ত্বেও জামাতে যেতে না পারার কষ্ট রয়েছে মনে। মাঝে-মধ্যে স্ক্রিনে সরাসরি সম্প্রচার দেখে বেদনার কিছুটা উপশমের চেষ্টা করেছি। বিশ্ব মুসলিমের সমাগমস্থল মক্কার এ অচেনাচিত্র অবলোকনে প্রতিটি মুমিনের হৃদয়কেই বেদনাহত করেছে। তবে, সরকারিভাবে নতুন সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছে। ৩১ মে থেকে ধীরে ধীরে সবকিছু খুলে দেওয়া হবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এ ঘোষণায় কিছুটা স্বস্তি এসেছে।
বলছিলাম ঈদের দিনের কথা। নানা কারণে সারাদিন বাইরে চোখ মেলে তাকানো হয়নি। ঈদের দিন ফজরের পর নিকটের মসজিদের মাইকে বেজে উঠা তাকবির ধ্বনি শুনে মনে ঈদের আনন্দ হৃদয়ে ধারণের চেষ্টা করেছি। দেশের প্রিয় মানুষদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ ও শুভেচ্ছা বিনিময় হয়েছে।
এসব পাওয়া না পাওয়ার কথা একজন মানুষ হিসেবে নিতান্তই সাময়িক। তবে একজন মুসলমান হিসেবে বিশ্বাস করি, ধ্বংসাত্মক এ মহামারিতে আল্লাহতায়ালা আমাদের সুস্থতার যে অমূল্য সম্পদ দিয়ে রেখেছেন- এক কথায় এসব আগামীর জীবনে তার ইবাদতে কাটানোর অপার সুযোগ প্রতিটি মুসলমানের জন্য। সুস্থ থাকার জন্যই আজকের এ দূরত্ব। প্রিয় মানুষগুলোকে ভালো রাখার জন্যই সাময়িক এ বিচ্ছেদ। সুস্থ থাকলে একদিন কাছে আসা হবেই। এটাই সান্তনা।