সর্বসম্মত আইনের ঘোষণা মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে সব সময়ই রাষ্ট্রপ্রধানদের ওপর শাসনতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের কাজ করেছে; সুশাসন বজায় রেখেছে; শাসকদেরকে স্বেচ্ছাচারী হওয়ার বদলে জবাবদিহিতা-স্বচ্ছতা-দায়িত্বশীলতার অধীনস্থ করেছে সর্বপরি ধর্ম-বর্ণ-ভাষা-সংস্কৃতি নির্বিশেষে তাবৎ জনসাধারণের অধিকার, শান্তি, নিরাপত্তা, সম্মান ও মর্যাদা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করেছে।
বস্তুত পক্ষে, হেরা গুহার নির্জন সাধক মানবতার মহান শিক্ষক, মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুক্তির বাণী উচ্চারণ না করা পর্যন্ত, মানুষের মাঝে সাম্য ঘোষণা না করা পর্যন্ত, প্রত্যেক শ্রেণী সুবিধার উচ্ছেদ আর শ্রমিকের মুক্তি সাধন না করা পর্যন্ত- যে শৃঙ্খল পৃথিবীর জাতিগুলোকে দাসত্বের বন্ধনে বেঁধে রেখেছিল; তা ভাঙেনি। যে বাণী তার পূর্বসূরীরা নিয়ে এসেছিলেন, তিনিও সেই বাণী নিয়ে আসেন আর তা বাস্তবে রূপায়িত করেন তিনিই। সংখ্যালঘু বা অমুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি ইসলামের রাজনৈতিক চরিত্রের চিত্র দেখা যাবে দু’টি জিনিসের মধ্যে-
১. হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) মদিনায় আগমনের পর ইহুদিদেরকে যে সনদ প্রদান করেছিলেন; এবং
২. ইসলাম আরব উপদ্বীপে পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর নজরান ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় খিস্টানদের কাছে যে বাণী প্রেরণ করা হয়েছিল।
শেষোক্ত দলিলটির বেশিরভাগই মুসলিম শাসকদের জন্য অমুসলিম ও সংখ্যালঘু প্রজাদের প্রতি আচরণের পথনির্দেশক মূলনীতি হিসাবে কাজ করছে। যদি কেউ এই নীতি থেকে বিচ্যুৎ হয়ে থাকে তবে তার কারণ খুঁজতে হবে সেই শাসকের চরিত্রের মধ্যে। রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তা অনেক সময় ধর্মের নামে কথা বলেছে, আর কাজ করেছে বলে যদি আমরা সেটাকে পৃথক করে ফেলি, তবে দেখা যাবে যে ইসলামের চেয়ে কোনো ধর্ম অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি বেশি সহনশীল নয়। ‘রাষ্ট্রীয় কারণবশত’ এখানে-ওখানে দু’একজন শাসনকর্তা কিছু কিছু অসহিষ্ণুতার প্রকাশ করেছে কিংবা কিছুটা ধর্মীয় ঐক্যের প্রতি জোর দিয়েছে। কিন্তু ইসলামে অমুসলমান বা সংখ্যালঘুদের জন্য নির্দেশিত ব্যবস্থাপনা সর্বকালে পূর্ণ সহনশীলতা বজায় রেখে চলেছে।
ধর্মাচরণের ক্ষেত্রে খ্রিস্টান আর ইহুদিদেরকে কখনো কোনো বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়নি বা ধর্ম পরিবর্তন করতে তাদেরকে কখননো চাপ দেওয়া হয়নি। তাদেরকে যদি কোনো বিশেষ কর (জিজিয়া) দিতে হয়ে থাকে, তবে সে সামরিক কার্যের পরিবর্তে, আর এটা খুবই ন্যায়সঙ্গত যে যারা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা লাভ করে তারা কোনো না কোনো আকারে সাধারণ দায়িত্ব পালনে অংশগ্রহণ করবে। পৌত্তলিকদের প্রতি নীতিগতভাবে কঠোরতা একটু বেশি, কিন্তু কাজের বেলায় আইন তাদের বেলায়ও সমানই উদার।
অথচ অখ্রিস্টান, ইহুদি, ধর্মবিরোধী আর পৌত্তলিকরা খিস্টান শাসনাধীনে অনিশ্চয়তার মধ্যে জীবন কাটাত। সব সময়ই এক ধরনের ঝুঁকি লেগে থাকত যে তাদেরকে হত্যা করা হতে পারে বা দাসে পরিণত করা হতে পারে। অধিকার বলতে তাদের কিছু ছিল না, কেবল প্রাণে বেঁচে থাকতে দিলেই যেন যথেষ্ট। কোনো খিস্টান অখ্রিস্টানের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক করলে, বৈধ সম্পর্কের তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না, তাকে পুড়িয়ে মারা হত। ইহুদিগণ পানাহারে বা এমনিই খ্রিস্টানের সঙ্গে একটেবিলে বসতে পারবে না বা তার মতো পোষাকও পরতে পারবে না। তাদের শিশু-সন্তানকে কোল থেকে ছিনিয়ে নেওয়া যেত, মালামাল লুট করা যেত, কোনো ব্যারন বা বিশপ বা ক্ষিপ্ত জনতার উগ্রকামনা অনুসারে। আর এই অবস্থা চলেছে ইসলামের আবির্ভাবের একদম পূর্বপর্যন্ত।
ইসলামের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে মনুষ্যত্বের দুরবস্থা সম্পূর্ণ বদলে যায়। নবী করিম (সা.) মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্রের গোড়াপত্তনের সময়ই নাগরিকগণের পারস্পরিক শান্তি, সৌহার্দ্য, সমানাধিকার ও সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করেন। নগরী ও এর অধিবাসীদেরকে অভ্যন্তরীণ গোলযোগ ও বহিঃশত্রুর আক্রমণ হতে রক্ষার জন্য এবং জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সামঞ্জস্য বিধানের ও পারস্পরিক শান্তি স্থাপনের উদ্দেশ্যে মুসলমান, ইহুদি ও পৌত্তলিক, এই তিন জাতির সমন্বয়ে একটি শান্তি চুক্তি সম্পাদন করেন, ইতিহাসে যার নাম ‘মদিনা সনদ।’ এতে সমানাধিকারের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ-
১. চুক্তিভূক্ত কোনো গোত্র বা সম্প্রদায় শত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হলে সকলে সমবেতভাবে তা প্রতিহত করবে;
২. চুক্তিবদ্ধ এক সম্প্রদায় কোনো শত্রুপক্ষের সঙ্গে সন্ধি করলে অন্য সম্প্রদায় এই সন্ধিতে যোগ দেবে;
৩. সবাই নিজ নিজ ধর্ম-কর্ম স্বাধীনভাবে পালন করতে পারবে এবং কেউ কারও ধর্মীয় কাজে হস্তক্ষেপ করবে না;
৪. উৎপীড়িতকে সবাই রক্ষা করবে;
৫. অপরাধী যে-ই হোক না কেন, তাকে উপযুক্ত শাস্তি ভোগ করতে হবে;
৬. নরহত্যা নিষিদ্ধ হবে;
৭. ওয়ারিশ বা আত্মীয়কে অর্থ প্রদান প্রথা চালু থাকবে;
৮. কেউ অপরাধ করলে তা তার ব্যক্তিগত অপরাধ বলে বিবেচিত হবে এবং তজ্জন্য তার জাতীয় স্বত্বাধিকার খর্ব করা চলবে না।
মদিনার সনদ মুসলমান ও অমুসলমানের মধ্যে কার্যকরী ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করেছিল এবং পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ-কলহের অবসান ঘটিয়েছিল। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে মদিনাবাসীর মধ্যে নাগরিক সংহতি ও ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। এ সনদ ছিল গণতন্ত্র ও সমানাধিকারের উজ্জ্বল উদাহরণ, যাতে নাগরিকতা ও ধর্মের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়। মদিনার সনদ বিশ্বের ইতিহাসে বিভিন্ন ধর্মানুসারীদের শান্তির সঙ্গে সহাবস্থানের এবং সমানাধিকার সমুন্নত রাখার প্রকৃত নিদর্শনবহ। একই রাষ্ট্রের বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী এবং পারস্পরিক বিরোধিতাপূর্ণ রুচি ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হয়েও নিজ নিজ ধর্মীয় ও সামাজিক স্বাতন্ত্র বজায় রাখার মাধ্যমে মর্যাদাপূর্ণ ও মানবাধিকারের বহিঃপ্রকাশ হিসাবে মদিনার সনদ আজও সকলের কাছে অনুসরণযোগ্য।
পরবর্তীকালে প্রণীত হুদায়বিয়ার সন্ধিতেও পরমতের প্রতি ইসলামের অনুপম সহিষ্ণুতার উজ্জ্বল প্রমাণ রয়েছে। অমুসলমান ও সংখ্যালঘুদের সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রে খোলাফায়ে রাশেদীন বা প্রাথমিক বিশুদ্ধ নেতৃত্বের অনুসরণে পরবর্তীরাও নৈতিক অবস্থানে অবিচল ছিলেন। আব্বাসীয় আমলে অমুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণের ভার দেওয়া হত একটি বিশেষ দফতরের ওপর।
সাত শতাব্দী ধরে স্পেনে মুসলমানরা শাসন করেছে এবং সেখানে অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও বংশীয় দ্বন্দ্ব সত্ত্বেও শাসনের হিতকারীরূপ সম্পর্কে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। স্পেন ছিল ইউরোপের নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের নিরাপদ ও সম্মানজনক আশ্রয়স্থল। অমুসলমান ও সংখ্যালঘুরা স্পেনের মতোই মুসলিম ভারতে গৌরবের সঙ্গে বসবাস করেছে।
অতএব, মুসলমান ও সংখ্যালঘু বা পরমতের প্রতি ইসলামের সমানাধিকারপূর্ণ, সম-মর্যাদাপূণ এবং সম্মানজনক আচরণ ইসলামের প্রাথমিক দিন থেকে বিরাজমান; ইসলামের ইতিহাসের প্রতিটি পর্যায়ে চর্চ্চিত; এখনও পর্যন্ত তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিত আদর্শিক নীতি হিসাবে আইনগত বাধ্যবাধকতার মাধ্যমে ইসলামের অনুসারীদের কাছে স্বীকৃত।
আরও পড়ুন: পর্ব- ৪: নির্যাতিত মানবগোষ্ঠী শান্তি ও নিরাপত্তা খুঁজে পায় ইসলামের ছায়াতলে