পবিত্র কোরআন মানুষকে কোনো সমাজ, রাষ্ট্র, এমনকি মহাবিশ্বের প্রকৃত লক্ষ্যরূপে বিবেচনা করা হয়েছে। সব কিছুই মানুষের কল্যাণের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যা আছে নভোমণ্ডলে এবং যা আছে ভূমণ্ডলে, তার পক্ষ থেকে সব কিছু তোমাদের আয়ত্ত্বাধীন করে দিয়েছেন।’ –সূরা আল জাসিয়া: ১৩
পবিত্র কোরআনে ‘রাষ্ট্র’ শব্দটি নেই, তবে দেশ এবং তা পরিচালনার ধারণা আছে তাতে। হজরত রাসূলুল্লাহ সালাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাই ঘোষণা করেন, ‘আমরা অবশ্যই এমন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবো, যাতে সুন্দরী তরুণীও অলঙ্কার পরিবেষ্টিত অবস্থায় একাকী ইয়েমেন থেকে বসরা (প্রায় ২০০ মাইল) সফর করতে পারে। কিন্তু আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে ভয় পাবে না সে।’ –সহিহ বোখারি
এর মানে হচ্ছে, কোনো ইসলামী রাষ্ট্রে তার সকল নাগরিকের জীবন, সম্মান ও সম্পদ নিরাপদ থাকবে। এভাবে ইসলাম সূচনাকাল থেকেই সকলের জন্য সর্বান্তকরণে শান্তি, আইনের শাসন, মর্যাদা ও অধিকারের প্রতিশ্রুতি ও নিশ্চয়তা বিধান করে আসছে। হজরত রাসূলুল্লাহ সালাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জীবদ্দশাতেই এ মহান প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করে গেছেন। ইসলামী রাষ্ট্রে নেতা নির্বাচন চূড়ান্তভাবে সমাজের উপর নির্ভরশীল। ইসলামের ঐতিহ্যবাহী ধ্যান-ধারণায় এই ধরণের প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র পালিত হয়। ফলে এ রাষ্ট্র জনঅংশগ্রহণমূলক, গণতান্ত্রিক এবং গতিশীল।
হজরত রাসূলুল্লাহ সালাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে প্রেরিত ঐশী বার্তায় মানব রচিত ও নির্মিত সকল মূর্তি, প্রতিরূপ, চেতনা ও আদর্শ ধ্বংস করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করা হয়েছে। সার্বভৌমত্বের কোরআনিক ধারণাও এ কারণেই অন্য সব মানবরচিত মতবাদ, আদর্শ ও ব্যবস্থার চেয়ে ভিন্ন। বাস্তবতা হল, কিছু লোককে কোনো মতবাদ বা আদর্শের নামে অন্যদের উপর কর্তৃত্ব দেওয়া হয়ে থাকে, যার ফলাফল ভয়ঙ্কর এবং পরিণতি স্বৈরতন্ত্র, ব্যক্তিতন্ত্র, দলতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র ইত্যাদি অমানবিকতায় প্রতিফলিত। পবিত্র কোরআন মানবরচিত সার্বভৌমত্বের ধারণাকে অত্যন্ত সঙ্গতভাবেই মানবতার জন্য অত্যন্ত বিপর্যয়কর বিবেচনা করে এবং একে অগ্রহণযোগ্য মনে করে। সার্বভৌমত্ব শুধুমাত্র আল্লাহতায়ালার এবং তা কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের নয়। এ ব্যাখ্যাকে না বুঝার কারণে অনেকে মনে করতে পারেন যে, ধর্মের নামে কিছু ধর্মীয় নেতার হাতে থাকবে সার্বভৌমত্ব। এটা বড় ভুল ও অজ্ঞতা।
মনে রাখা ভালো, সার্বভৌমত্ব নিরঙ্কুশ এবং এটা দেখা যায় না। আমাদেরকে নিদের্শনা দিতে আল্লাহতায়ালা পৃথিবীতে নেমে আসবেন না। তার বাণী অবতীর্ণ হয় তার বার্তাবাহকদের মাধ্যমে। আর এ কারণেই পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, বার্তাবাহককে মান্য করা মানে আল্লাহকে মান্য করা। পালন করার জন্যই ঐশী বিধানগুলো অবতীর্ণ হয়েছে। আর ঐশী নিদের্শের কোনো পরিবর্তনের অধিকার কাউকে, এমনকি, তার বার্তাবাহকদেরও দেওয়া হয়নি। ‘আপনি তাদের পারস্পরিক ব্যাপারে আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, সে অনুযায়ী ফয়সালা করার।’ –সূরা আল মায়েদা: ৪৮
ঘোষণায় সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ্যভাবে আরও বলা হয়েছে, ‘একে নিজের পক্ষ থেকে পরিবর্তিত করা আমার কাজ নয়।’ –সূরা ইউনুস: ১৫
ফলে খোদ বার্তাবাহকরাই প্রথমে এবং পরিপূর্ণভাবে ঐশী নিদের্শের প্রতি আনুগত্য করেছেন। এটা এমন এক ব্যবস্থা যাতে কেউ শাসক হবে না, আবার কেউ শাসিতও হবে না। আমাদেরকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, হজরত রাসূলুল্লাহ সালাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো নিজেকে শাসক, রাজা বা সম্রাট হিসাবে অভিহিত করেননি। যদিও লাখ লাখ বর্গমাইল এলাকায় তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তার ওফাতের পর ব্যবস্থাটি খলিফাদের মাধ্যমে কার্যকর ছিল এবং তাদের আনুগত্য করার অর্থ আল্লাহর বিধানের প্রতিই আনুগত্য করা। ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় শাসনের পাশাপাশি বিচার ব্যবস্থাও প্রতিষ্ঠিত কেবলমাত্র ঐশী বিধান অনুযায়ী।
ইসলাম রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, ব্যক্তিতন্ত্র অনুমোদন করে না। ইসলামের বিধি-বিধানকে ধর্ম বা আচরণ হিসাবে পালন করা হয় এবং পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা বা দ্বীন হিসাবে আল্লাহ প্রবর্তিত ব্যবস্থায় মানব ব্যক্তিত্বকে নিরাপদ, বিস্তৃত ও বিকশিত করার সুযোগ রয়েছে। এর মাধ্যমে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে জান, মাল, সম্মানের পূর্ণ নিরাপত্তা থাকবে এবং আশ্রয়, খাবারসহ সকল মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা থাকবে। সর্বপরি সমাজে থাকবে ন্যায়বিচার, সাম্য, মর্যাদা, নিরপেক্ষতা ও সকলের সম্মানজনক অধিকার।
অমুসলমান ও সংখ্যালঘুদের প্রতি ইসলাম ও মুসলমান শাসকদের ন্যায়ানুগ, সম্মানজনক, মর্যাদাপূর্ণ ও সমানাচরণের পেছনে সর্বদাই কাজ করেছে সুস্পষ্ট আদর্শিক ও নৈতিক ভিত্তি আর নির্দেশনা। সূচনা থেকে আজ পর্যন্ত ইসলাম সব সময় অনন্য লক্ষ্য হিসাবে সামনে রেখেছে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রচারিত আল্লাহর অর্থাৎ ঐশ্বরিক, একত্ব আর মানুষের সাম্যের শিক্ষা। যতক্ষণ আল্লাহর একত্ব আর রাসূলের (সা.) বাণীর মূল সত্যটি স্বীকৃত ও গৃহীত হচ্ছে, ততক্ষণ ইসলাম মানুষের বিবেকের ও অধিকারের সবচেয়ে বিস্তৃত স্বাধীনতা দান করেছে।
ফলে মুসলমানরা যেখানেই গিয়েছেন, সেখানেই পদদলিত জনসাধারণ আর নির্যাতিত বিরুদ্ধবাদীরাও সাদরে বরণ করেছে। ইসলামকে তারা পেয়েছে তাদের যন্ত্রণাদায়ক দাসত্ব থেকে স্বাধীনতা আর মুক্তির অগ্রদূত হিসাবে। ইসলাম তাদেরকে দিয়েছে আইনের চোখে বাস্তব সমতা আর স্থায়ী নিরাপত্তা, সম্মান, অধিকার ও শান্তি; যা পূর্বের স্বেচ্ছাচারের চেয়ে বিস্তর সুশাসন ও সমানাধিকারের নিশ্চয়তা এনে দিয়েছে অমুসলমান, সংখ্যালঘু ও স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে। বিশ্বের দেশে দেশে ইসলামের আগমন এজন্যই স্বতস্ফূর্ত, কাম্য, জন-কল্যাণধর্মী এবং নিবর্তনের বিরুদ্ধে ন্যায় ও সমতার আলোকবাহী; যা আধুনিক উপনিবেশবাদ, ভোগবাদ, সম্প্রসারণবাদ, সাম্রাজ্যবাদ বা আধিপত্যবাদের সঙ্গে ইসলামের মৌলিক পার্থক্য নিদের্শ করে।
কাদিসিয়ার যুদ্ধে ইসলামের অউপনিবেশবাদী, অসাম্রাজ্যবাদী মনোভাবের বিপরীতে মানব-সাম্যের প্রকৃত রূপটি চিত্রিত্র হয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে কাদিসিয়ার যুদ্ধ বিশাল পারস্য সাম্রাজ্যকে ইসলামের অধীনস্থ করে। কিন্তু এরচেয়ে বড় সত্য হচ্ছে, কাদিসিয়ার যুদ্ধ ছিল পারসিকদের মুক্তির সনদ।
যেমন ইয়ারমুক আর আজনাদাইনের যুদ্ধ ছিল সিরিয়া, গ্রীস আর মিসরের অধিবাসীদের মুক্তির সঙ্কেত। ইহুদিরা, যাদেরকে পারস্যে প্রতিষ্ঠিত অগ্নি-উপাসক যরথুস্ত্রীয়রা মাঝে মাঝে কচু-কাটা করত, আর খ্রিস্টানরা ইহুদিদের দেশে দেশে শিকার করে বেড়াত, সবাই মুক্তির সুবাতাস পেল হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) এবং তার মহত্তম অনুসারীগণ (রা.)-এর শাসনাধীনে, যেখানে ধর্মবিশ্বাসের মূল কথাই ছিল মানুষের ভ্রাতৃত্ব। অমুসলমান ও সংখ্যালঘুদের প্রতিও ভ্রাতৃত্বের এই সম্মানজনক দ্বার খোলা রয়েছে বলেই ইসলাম ও মুসলমানদেরকে পৃথিবীর ইতিহাসে পাওয়া যাচ্ছে মানবতার মুক্তিদাতা হিসাবে।
ফলে ইসলামের অগ্রযাত্রায় যদি কোথাও প্রতিরোধ এসে থাকে, তবে তা করেছে সুবিধাভোগী পুরোহিত ও অভিজাত সম্প্রদায়গুলো। চিরস্থায়ী সত্যের একটি কলেমার সরল স্বীকৃতি সাধারণ মানুষ আর শ্রমিক শ্রেণীকে দাঁড় করায় অধীনতা থেকে বিজয়ীর সারিতে; মুসলিম মুক্তিদাতাদের সম-মর্যদায়। এমন কি, উপজাতি আর গ্রামের সামন্ত দলগুলোর সমস্ত সুবিধা, সম্মান আর প্রতিপত্তি অক্ষুন্ন থাকে।
আরও পড়ুন: পর্ব-২: সংখ্যালঘুর সমানাধিকার ও সম্মানের শিক্ষা দেয় ইসলাম