ধর্মীয়, জাতিগত, ভাষাগত সংখ্যালঘুর মানবাধিকারের দাবিতে সোচ্চার বিশ্ব সম্প্রদায় আইনগত ও সামরিক-বেসামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেও বিশ্বব্যাপী নিপীড়িত মানবতার আহাজারি থামাতে পারছে না। বরং ইসলামে সংখ্যালঘুর অধিকার সংরক্ষণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত থাকার পরেও মুসলিমরাই হচ্ছে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত। ‘ইসলামে সংখ্যালঘুর অধিকার’ সম্পর্কে ঐতিহাসিক পর্যালোচনা: পর্ব-১
নীতিগত ও ব্যবহারিক অর্থে ইসলাম কোনো জাতি, বর্ণ, অঞ্চল বা রঙের পার্থক্য মানে না। সাদা আর কালো, নাগরিক আর সৈনিক, শাসক আর শাসিত, সব সমান; কেবল নীতিগত বা তত্ত্বগতভাবেই নয়, ব্যবহারিক-প্রায়োগিক কাজেও। ময়দানে বা মেহমানখানায় হোক, তাবুতে বা প্রাসাদে হোক, মসজিদে বা বাজারে হোক, তারা মেলামেশা ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন অবাধে, অকপটে; স্বাধীনতা ও সাম্যের ভিত্তিতে।
ইসলামের প্রথম মোয়াজ্জিন ছিলেন একজন নিগ্রো ক্রীতদাস। সাদা-চামড়ার বর্ণবাদী মানুষের কাছে তার সধর্মীয় কালো মানুষেরা স্বর্গের রাজ্যে সমান হতে পারে, এই পৃথিবীর রাজ্যে কিছুতেই নয়। পৃথিবীর বাস্তব জীবনে এমনই কঠোর পার্থক্য বিরাজমান। কিন্তু ইসলাম বর্ণবাদ ও বর্ণবৈষম্যকে প্রথম দিন থেকেই সমাজ, ধর্ম ও জীবনের সর্বক্ষেত্রে অস্বীকার করেছে।
ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিম প্রজাদেরকে বলে ‘আহল উজ-জিম্মাহ’ বা ‘জিম্মি।’ শব্দটির অর্থ হলো- ‘যারা নিরাপত্তায় বাস করে।’ হজরত আলী (রা.) জিম্মিদের সম্পর্কে ইসলামী বিধান ও দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট করেছেন তার বিখ্যাত ও অনুসরণযোগ্য এই উক্তির মাধ্যমে, ‘জিম্মির রক্ত মুসলমানের রক্তের মতো।’
সাধারণভাবে ভুল তথ্য ও ধারণার ভিত্তিতে ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিম প্রজারা কঠিন অসুবিধায় থাকার যে অভিযোগ, তার সমর্থনে শুধু যে শাস্ত্রবিদ আর আইনবিদদের সংকীর্ণতার কথা উল্লেখ করা হয় তা নয়; হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অমুসলিমদেরকে সুনজরে দেখেননি আর তাদের সঙ্গে তার শিষ্যদের বন্ধুসুলভ সম্পর্ক উৎসাহিত করেননি, এমনটি দেখানোর জন্য কোরআনের কয়েকটি আয়াতের উল্লেখও করা হয়। কিন্তু এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনাকালে মনে রাখতে হবে, এই আয়াতগুলো অবতীর্ণ হওয়ার প্রেক্ষাপট, সেই সময়ে জীবন-মরণ সংগ্রামে লিপ্ত অবস্থায় ইসলাম কী কঠিন চাপ ও কষ্টের ভিতর দিয়ে অতিক্রম করছিল; আবার পৌত্তলিক আর ইহুদি ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়গুলো কী রকম ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মুসলমানদেরকে কলুষিত করে নতুন ধর্ম থেকে ভাঙানি দেওয়ার চেষ্টা করেছিল।
এরূপ বিপদের সময়ে নবী করিম (সা.)-এর একান্ত (ঐশী) কর্তব্যই ছিল বিরোধী পক্ষগুলোর প্রতারণা আর বিশ্বাসঘাতকতামূলক অভিসন্ধির বিরুদ্ধে শিষ্যদের সতর্ক করে দেওয়া। আর তুলনামূলক ইতিহাসের কোনো ছাত্রই তাকে দোষারোপ করতে পারবে না- তিনি শত্রু আর বিদেশিদের ষড়যন্ত্র থেকে তার ক্ষুদ্র মদিনা নামক গণরাজ্যকে রক্ষার চেষ্টা করেছিলেন বলে। কিন্তু যখন আমরা অমুসলিম-সংখ্যালঘুসহ নাগরিকদের প্রতি তার সাধারণ ব্যবহার বিচার করতে বসি, তখন আমরা তাতে ইসলামের মানবিকবোধ ও নবীর প্রশস্ত হৃদয়ের সহনশীলতা আর সহানুভূতির স্পষ্ট চিহ্ন দেখতে পাই।
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কথা ও কাজের মধ্যে দেখা যাবে অধীনস্থ জাতিগুলোকে কিরূপ নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছিল। কোনো বিজয়ী জাতি বা ধর্ম এর চেয়ে ভালো নিরাপত্তা কি কখনো দিতে পেরেছে? না পারেনি। উদাহরণ রয়েছে শত শত। যেমন, ‘নজরান ও পার্শ্ববর্তী এলাকার (খিস্টানদের) প্রতি, আল্লাহর নিরাপত্তা আর তার রাসূলের প্রতিশ্রুতি তাদের জীবনের প্রতি, তাদের ধর্মের প্রতি আর সম্পদের প্রতি প্রসারিত করা হলো, যারা উপস্থিত আছে আর যারা অনুপস্থিত আছে আর তাদের ছাড়াও অন্যদের প্রতি; তাদের ধর্মের ব্যাপারে আর তাদের ধর্মাচরণের ব্যাপারে কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ করা হবে না; তাদের অধিকার আর সুযোগ-সুবিধার কোনো পরিবর্তন করা হবে না; কোনো বিশপকে তার এলাকা থেকে অপসারণ করা হবে না; কোনো মঠ থেকে কোনো সাধুকেও না, কোনো পুরোহিতকে তার পদ থেকেও না; আর তারা আগের মতো ছোট বড় সকল অধিকার ভোগ করতে থাকবে; কোনো মূর্তি বা ক্রস ধ্বংস করা যাবে না; তারা কাউকে উৎপীড়ন করবে না, বা তাদেরকেও উৎপীড়ন করা হবে না; তারা অজ্ঞতার যুগের মতো রক্তের প্রতিশোধ প্রথা আচরণ করবে না; তাদের কাছ থেকে উশর-খাজনা আদায় করা হবে না বা তাদেরকে সেনাবাহিনীর জন্য আহার্য যোগাতেও হবে না।’
নবী করিম (সা,)-এর নিষ্ঠাবান অনুসারীরাও রেখেছেন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। হিরা অধিকারের পর জনসাধারণ আনুগত্যের শপথ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খালিদ ইবনে ওয়ালিদ একটি ঘোষণা প্রচার করেন। এই ঘোষণায় তিনি খ্রিস্টানদের জীবন, স্বাধীনতা আর সম্পত্তির নিরাপত্তা দান করেন, আর ঘোষণা করেন, ‘তাদেরকে নাকূস (প্রাচ্যের খ্রিস্টান গির্জায় ঘণ্টার পরিবর্তে ব্যবহৃত একখণ্ড কাষ্ঠ) বাজাতে আর উৎসবের সময় ক্রস বের করতে বাধা দেওয়া হবে না।’
ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় অমুসলিম প্রজাদের জন্য গির্জা বা মন্দির নির্মাণ নিষিদ্ধ ছিল না। পরবর্তী সময়ে, বাগদাদে, আল-মামূনের শাসনকালে সমস্ত সাম্রাজ্যে শত শত ইহুদি সিনাগগ ও অগ্নি-মন্দির ছাড়াও এগার হাজার খ্রিস্টান গির্জার অস্তিত্বের কথা জানা যায়। অথচ এই সুশিক্ষিত খলিফাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে, ‘খ্রিস্টানদের ঘোর শত্রু’ (!) বলে। কিন্তু তিনি তার পরামর্শ সভায় তার অধীনস্থ সকল সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি গ্রহণ করেছিলেন। মুসলিম, ইহুদি, খ্রিস্টান, সাবাঈ আর যরথুস্ত্রীয়। এদিকে খ্রিস্টান পুরোহিততন্ত্রের অধিকার আর সুবিধাবলীও যত্ন সহকারে নিশ্চিত করা হত।
অমুসলিম প্রজাদের কল্যাণ সাধনে ব্যগ্র বাগদাদের খলিফারা স্পেনের কর্ডোভার সুলতানদের মতো একটি বিশেষ বিভাগ সৃষ্টি করেন। এই বিভাগের দায়িত্ব ছিল জিম্মিদের নিরাপত্তা ও স্বার্থ সংরক্ষণ। এই বিভাগটির প্রধানকে বাগদাদে বলা হত, ‘কাতিব আল জিহবাযেহ’ আর স্পেনে বলা হত ‘কাতিব আল জিমাম।’ বিষয়টি ছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য একটি আলাদা মন্ত্রণালয়স্বরূপ।
একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা- যার নজির আধুনিক ইতিহাসেও বিরল। তা হচ্ছে, মিসর বিজয়ের পর খলিফা হজরত ওমর (রা.) যত্ন সহকারে খ্রিস্টান গির্জার ওয়াকফ্ সম্পত্তির সংরক্ষণ করেন, আর ভূতপূর্ব সরকার পুরোহিত শ্রেণীর পোষণের জন্য যে ভাতার ব্যবস্থা করেছিল তা তিনি চালু করেন। পরবর্তী খলিফা হজরত ওসমান (রা.)-এর শাসনকালে মার্ভের খ্রিস্টান পুরোহিত ফ্রান্সের বিশপ সাইমেয়নকে এইরূপ সম্বোধন করেন, ‘আরবদেরকে (মুসলিমদেরকে) আল্লাহ পৃথিবীর রাজত্ব দান করেছেন, তারা খ্রিস্টান ধর্মকে আক্রমণ করে না; উপরন্তু তারা আমাদের ধর্মকে সাহায্য করে। তারা আমাদের খোদা ও সেন্টদেরকে সম্মান করে আর আমাদের গির্জা আর মঠের জন্য সম্পত্তি দান করে।’