বলা হয়, স্বাস্থ্যই সম্পদ। তাই মানুষের জন্য শারীরিক, মানসিক ও আত্মিক সুস্থতাকে আল্লাহ প্রদত্ত আমানত বলা হয়। এ বিষয়ে হাদিস শরিফে এসেছে, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন- ‘দু’টি নিয়ামতের বিষয়ে বেশিরভাগ মানুষ অসতর্ক ও প্রতারিত। সেগুলো হলো- সুস্থতা ও অবসর। -সহিহ বোখারি
কিয়ামতের দিন মানুষকে যেসব নিয়ামত সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে তন্মধ্যে সর্বপ্রথম প্রশ্ন করা হবে সুস্থতা প্রসঙ্গে। তাকে বলা হবে, ‘আমি তোমাদের শারীরিক সুস্থতা দেইনি?’ -সুনানে তিরমিজি
ইসলামের দৃষ্টিতে ‘অসুস্থ হয়ে চিকিৎসা গ্রহণের তুলনায় স্বাভাবিক অবস্থায় স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা উত্তম।’ আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানও এ কথা বলে। অর্থাৎ রোগ প্রতিরোধ রোগ নিরাময়ের চেয়ে শ্রেয়। রোগাক্রান্ত হলে অবিলম্বে চিকিৎসা নেওয়া ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে জরুরি। নবী করিম (সা.) অসুস্থ হলে নিজে চিকিৎসা নিতেন এবং তার অনুসারীদের চিকিৎসা নিতে উৎসাহিত করতেন।
সুস্থতার জন্য নবী করিম (সা.) মানবজাতিকে বেশকিছু নির্দেশনা দিয়েছেন, এসব মেনে চললে সুস্থতা অবধারিত। ওই সব নির্দেশনার অন্যতম হলো-
এক. মানুষ সাধারণত রোগাক্রান্ত হয় খাদ্য ও পানীয়ের দ্বারা। সে হিসেবে সব রোগের মূল কেন্দ্রস্থল মানুষের পেটা। তাই খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে পরিমিত মাত্রায় খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। ইসলাম এ বিষয়ে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করতে নির্দেশ দিয়েছে এবং অতি ভোজন করতে নিরুৎসাহিত করেছে।
হাদিসে বর্ণিত আছে, হজরত রাসূলে আকরাম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘পেটের এক-তৃতীয়াংশ খাদ্য দিয়ে, এক-তৃতীয়াংশ পানীয়ের জন্য এবং এক-তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য খালি রাখবে।’ -সুনানে ইবনে মাজাহ
দুই. খাবার ও পানীয় ঢেকে রাখা। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) খাদ্য ও পানীয় সব সময় ঢেকে রাখার জোর তাকিদ দিয়েছেন। কেননা, তাতে অসুস্থতার পাশাপাশি মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে।
হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত রাসূলে আকরাম (সা.) বলেন, ‘তোমরা খাদ্য ও পানীয় ঢেকে রাখো, মশকের (পানির পাত্র) মুখ বন্ধ করে দাও, প্রদীপ নিভিয়ে দাও এবং ঘরের দরজা বন্ধ করে দাও। কারণ, শয়তান বন্ধ মশক খুলতে পারে না, বন্ধ দরজাও খুলতে পারে না এবং বন্ধ পাত্রও খুলতে পারে না। তোমাদের কোনো ব্যক্তি যদি পাত্র ঢাকার মতো কিছু না পায়, তবে সে যেন একটি কাঠ আড়াআড়িভাবে রেখে দেয় এবং আল্লাহর নাম স্মরণ করে।’ -সুনানে ইবনে মাজাহ
তিন. খাদ্যে ফুঁ না দিয়ে খাবার শুরু করা। খাবার ও পানীয়ে ফুঁ দেওয়ার কারণে অনেক ধরনের রোগ হতে পারে। হজরত আবু সাইদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) পানীয়ে ফুঁ দিতে নিষেধ করেছেন। একজন আরজ করল, পাত্রে কখনও কখনও ময়লা দেখা গেলে কী করা? তিনি (সা.) বললেন, ‘তা ঢেলে ফেলে দেবে।’ –সুনানে তিরমিজি
আধুনিক বিজ্ঞান বিষয়টিকে জোর দিয়ে আমল করার পরামর্শ দিয়েছে। কারণ, পানীয়ে ফুঁ দিয়ে তা পান করলে তাতে কার্বন ডাই অক্সাইড মিশে আমাদের শরীরে ক্ষতিকারক জটিলতা সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে।
চার. হাত পরিষ্কার রাখার অভ্যাস সবারই থাকা দরকার। যার মাধ্যমে সহজেই অসুস্থতা থেকে বাঁচা যায়। হাত নানা ধরনের জীবাণু বহন করে বিভিন্ন স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায়। তাই রোগমুক্ত থাকতে নিয়মিত ভালোভাবে হাত ধুতে হবে। সঠিক নিয়মে হাত ধোয়ার অভ্যাস একটি ভালো ভ্যাকসিনের চেয়ে বেশি কাজ করে। তাই দেড় হাজার বছর আগে খাওয়ার আগে ও পরে হাত ধৌত করার প্রতি ইসলামের নির্দেশ এসেছে।
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) খাওয়ার আগে হাত ধোয়ার আদেশ দিয়েছেন। আম্মাজান হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) পানাহারের আগে উভয় হাত কব্জি পর্যন্ত ধুয়ে নিতেন।’ -মুসনাদে আহমাদ
আবার পায়খানা থেকে পানি খরচ করার পর বাইরে এসে মাটিতে হাত মলার অভ্যাস ছিল নবী করিম (সা.)-এর। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘যখন নবী করিম (সা.) পায়খানায় যেতেন আমি তার জন্য পিতল বা চামড়ার পাত্রে পানি নিয়ে যেতাম। অতঃপর তিনি (সা.) ইস্তেঞ্জা করে মাটিতে হাত মলতেন।’ -সুনানে আবু দাউদ
পাঁচ. দৈহিক সুস্থতার পাশাপাশি মানসিক সুস্থতাও জরুরি। বরং মানসিক সুস্থতা দৈহিক সুস্থতার পূর্বশর্ত। কারণ মানসিক প্রশান্তি ও উৎফুল্লতা দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। মানসিক উৎকণ্ঠা ও অস্থিরতা দেহের রোগ প্রতিরোধ কমিয়ে ফেলে। তাই ইসলাম মনোদৈহিক স্বাস্থ্যের প্রতি লক্ষ রেখে বৈবাহিক জীবন ব্যবস্থার প্রতি খুব গুরুত্ব দিয়েছে। তা ছাড়া ইসলামের ইবাদত ব্যবস্থা ও জিকির-আজকারের দ্বারাও মানসিক প্রশান্তি লাভ করা যায়।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘জেনে রাখো! আল্লাহতায়ালার জিকির দ্বারা অন্তরসমূহ প্রশান্ত হয়।’ -সূরা রাদ: ২৮
ছয়. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইসলামের মৌলিক নির্দেশনা ও ঈমানের অঙ্গ। পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার প্রতিও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কারণ, পরিবেশ দূষণের কারণে মানবসমাজে বিভিন্ন ধরনের রোগ ছড়ায়।
হাদিসে এসেছে, হজরত রাসূলে কারিম (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা তোমাদের বাড়ির আঙ্গিনার সব দিকে পরিষ্কার রাখবে। ইহুদিদের অনুকরণ করো না। তারা বাড়িতে আবর্জনা জমা করে রাখে।’ -সুনানে তিরমিজি
তা ছাড়া কেউ যদি মিসওয়াক, অজু, গোসল, পোশাক-আশাক প্রভৃতির ক্ষেত্রে ইসলামি নির্দেশনা মেনে চলে, তাহলে সে অপরিচ্ছন্নতাজনিত রোগব্যাধি থেকে নিরাপদ থাকতে পারবে।
সাত. যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগ করা নিষেধ করা হয়েছে। কারণ তাতে রোগব্যাধি ছড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত রাসূলে কারিম (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা তিন অভিশপ্ত ব্যক্তি থেকে বেঁচে থাকো। তারা হলো- যে পানির ঘাটে, রাস্তার ওপর ও গাছের ছায়ায় মলমূত্র ত্যাগ করে।’ -সুনানে আবু দাউদ
এক কথায়, আধুনিক বিজ্ঞান মানবদেহ রোগাক্রান্ত হওয়ার যেসব দিক নির্ণয় করেছে এবং এর প্রতিষেধক আবিষ্কার করেছে, তা প্রায় দেড় হাজার বছর আগে মানবতার কল্যাণ ও মুক্তির কাণ্ডারি বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) পুরোপুরিভাবে কোরআন ও হাদিসে বর্ণনা করে গেছেন।
তাই বলা যায়, ইসলাম এমন একটি জীবন ব্যবস্থার নাম, যেখানে মানবতার কল্যাণ ও সফলতার জন্য যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার, সেখানে তাই করা হয়েছে।