হিজরতের ছয় বছর পর হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনা থেকে উমরা পালনের জন্য ১ হাজার ৪০০ সাহাবাকে নিয়ে মক্কার উদ্দেশে যাত্রা করেন। মক্কা থেকে মাত্র ৯ মাইল দূরে হুদায়বিয়া নামক স্থানে পৌঁছলে কোরাইশরা তাদের গতিরোধ করে। মুশরিকরা যে কোনো মূল্যে মুসলমানদের মক্কায় প্রবেশে করতে বাধা দিতে তৎপর হয়। মুশরিকদের এ অন্যায় আস্ফালনের চূড়ান্ত জবাব দিতে মুসলমানরা হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অনুমতির অপেক্ষায় ছিলেন। মুসলমানরা খোদায়ি মদদে কুফরি শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করতে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কারণ এরই মধ্যে বহু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার অভিজ্ঞতা যে ছিল মুসলমানদের! তারা কোনোভাবেই নতজানু হওয়ার পাত্র নয়। এক অদম্য মনোবল নিয়ে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হুকুমের অপেক্ষা করছিলেন তারা।
কিন্তু আল্লাহর রাসূল (সা.) শান্তির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সাহাবাদের প্রতিরোধ আকাঙ্ক্ষা ও প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও মুশরিকদের সঙ্গে এক অসম চুক্তিতে উপনীত হয়েছিলেন। ওই চুক্তিতে ছিলো-
১. উভয়পক্ষ আগামী ১০ বছরের জন্য কোনো যুদ্ধে জড়াবে না,
২. এ বছর মক্কায় প্রবেশ না করেই ফিরে যেতে হবে,
৩. আগামী বছর মুসলমারা উমরা করতে এসে তিন দিনের বেশি অবস্থান করতে পারবে না। আর আত্মরক্ষার জন্য কোষবদ্ধ তরবারি ছাড়া অন্য কোনো অস্ত্র বহন করতে পারবে না,
৪. কোরাইশদের কোনো লোক তাদের অভিভাবকদের অনুমতি ছাড়া পালিয়ে মদিনায় চলে এলে মুসলমানরা তাকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য থাকবে,
৫. কোনো মুসলমান ইসলাম ছেড়ে মক্কায় চলে এলে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে না।
প্রত্যক্ষ দৃষ্টিতে চুক্তির শর্তগুলো মুসলমানদের স্বার্থবিরোধী হওয়া সত্ত্বেও হজরত রাসূলুল্লা (সা.) ‘যুদ্ধ নয় শান্তি’ এ নীতিকে অগ্রাধিকার দিয়ে প্রমাণ করলেন, মুসলমানরা একটি শান্তিকামী দল। তারা জোর-জবরদস্তি ও নৈরাজ্যে বিশ্বাস করে না।
তাছাড়া এ চুক্তির মাধ্যমে ফুটে উঠেছিল হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা। এ চুক্তির মাধ্যমেই মূলত কোরাইশরা মুসলমানদের কূটনৈতিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে, যা ছিল মুসলমানদের জন্য এক অভূতপূর্ব রাজনৈতিক বিজয়। হুদাইবিয়ার সন্ধি ইসলামের ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
হুদায়বিয়ার সন্ধির মাধ্যমে নবী করিম (সা.)-এর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় মেলে। এর পথ ধরে মক্কা বিজয়ের পথ পরিষ্কার হয়ে যায়। এ চুক্তির ফলে মুসলমানরা আরব বিশ্বে একটি শক্তিধর জাতির সম্মান লাভ করে। আল্লাহতায়ালা কোরআনে কারিমে হুদায়বিয়ার সন্ধিকে তাই ‘ফাতহুম মুবিন’ বা সুস্পষ্ট বিজয় হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এই মহান সন্ধির ধারাবাহিকতায় ইসলামের উত্তরোত্তর প্রসার এবং সর্বোপরি ৮ম হিজরিতে মক্কা বিজয় সম্পন্ন হয়েছে, যা বিশ্বজয়েরও সূচনা করে।
হুদায়বিয়ার সন্ধি দুই বছর স্থায়ী হয়। এই দুই বছরে ইসলাম অনেকটাই শক্তিশালী হয়। সন্ধি কার্যকর হওয়ার পর খুযায়া গোত্র মুসলমানদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করে। পক্ষান্তরে মুসলমানদের শত্রু বনু বকর কোরাইশদের সঙ্গে মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ হয়। মুসলমানদের জনপ্রিয়তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। এর ফলে কোরাইশদের অন্তর্জ্বালা বাড়তে থাকে, তাদের মধ্যে জন্ম নেয় প্রচণ্ড ক্রোধ। খুযায়া গোত্র নবী করিম (সা.)-এর সঙ্গে মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ায় কোরাইশরা তাদের মিত্র বনু বকরকে খুযায়া গোত্র আক্রমণের জন্য প্ররোচনা দিতে থাকে। এই গোপন চক্রান্তের ফলে বনু খুযায়াবাসী যখন ‘ওয়াতির’ নামক জলাশয়ের নিকট এক রাত্রে নিদ্রামগ্ন ছিল, তখন অতর্কিতভাবে বনু বকর তাদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে বনু খুযায়ার অনেক লোককে হত্যা ও তাদের ধন-সম্পদ লুট কর নিয়ে যায়।
কোরাইশরা এই আক্রমণে তাদের প্রকাশ্যে সাহায্য করে। বনু খুযায়া গোত্র এই নৃশংসতার বিরুদ্ধে কোরাইশদের নিকট অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার না পেয়ে নবী করিম (সা.)-এর নিকট তাদেরকে রক্ষা করার জন্য একটি প্রতিনিধি দল প্রেরণ করে। নবী করিম (সা.) সাহাবিদের সঙ্গে পরামর্শ করে কোরাইশদের তিনটি শর্ত দিয়ে এর যে কোনো একটি বেছে নেওয়ার জন্য বার্তা প্রেরণ করেন-
১. খুযায়া গোত্রের যেসব লোককে হত্যা করা হয়েছে, কোরাইশদের তার রক্তপণ প্রদান করতে হবে,
২. বনু বকরের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে,
৩. কোরাইশদেরকে হুদাইবিয়া সন্ধি বাতিল বলে ঘোষণা করতে হবে।
কোরাইশ পক্ষ প্রথম দু’টি শর্ত মেনে নিতে অস্বীকার করে কুরত ইবন উমারের মাধ্যমে নবী করিম (সা.)-এর নিকট সংবাদ পাঠায় এবং এই সংবাদে তারা জানিয়ে দেয় যে, তারা তৃতীয় শর্তটি গ্রহণ করেছে।
কোরাইশদের পক্ষে এটা ছিল একটি অবিবেচনাপ্রসূত পদক্ষেপ। হুদায়বিয়ার সন্ধি চুক্তি বিলুপ্তির অনিবার্য ভয়াবহ পরিণতি উপলব্ধি করতে পেরে পরবর্তীতে আবু সুফিয়ান চুক্তিটি নবায়নের উদ্দেশ্যে নিজেই মদিনায় নবী করিম (সা.)-এর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য গমন করেন। কিন্তু তার প্রস্তাবের পাশাপাশি মুসলমানদের দাবির প্রতি তিনি কর্ণপাত করেননি। এটি ছিল নিতান্তই অযৌক্তিক। ফলে নবী করিম (সা.) তার চুক্তি নবায়নের প্রস্তাবে সম্মত হননি।
চুক্তির স্থানটিতে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। মসজিদের নাম, হুদায়বিয়া মসজিদ। জেদ্দা থেকে মক্কাগামী সড়কের যে স্থানে হারাম শরিফের সীমা শুরু হয়েছে এ স্থানটি ঠিক সেখানে অবস্থিত। বর্তমানে এ স্থানটির নাম শুমাইসি।