আল্লাহতায়ালা নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ করেছেন দ্বিন ইসলামকে বিজয়ী ও পূর্ণতা দানের জন্য। যখন দ্বিন ইসলাম বিজয় ও পূর্ণতা লাভ করে তখন তিনি তার বিদায়ের কথা অনুভব করেন। তাই তিনি হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.)-কে ইয়েমেনের গভর্নর নিযুক্ত করে প্রেরণকালে বলেছিলেন, ‘হে মুয়াজ! সম্ভবত এ বছরের পর আমার সঙ্গে তোমার আর সাক্ষাৎ হবে না। হয়তো তুমি আমার মসজিদ ও আমার কবরের পাশ দিয়ে গমন করবে।’ নবী কারিম (সা.)-এর এ কথা শুনে হজরত মুয়াজ (রা.) প্রিয় নবীর বিদায়ের কথা ভেবে কাঁদতে লাগলেন।
পবিত্র হজ গমনের বাসনা
নবী কারিম (সা.) দশম হিজরির শেষার্ধে যখন পৃথিবীতে তার অবস্থানের মেয়াদকাল শেষ হওয়ার বিষয়টি অনুভব করলেন তখন তিনি সমগ্র বিশ্বের মানুষের সামনে শরিয়ত ও আখলাকের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো স্পষ্টভাবে পেশ করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করলেন। আল্লাহতায়ালাও চেয়েছিলেন তার হাবিবকে দীর্ঘ ২৩ বছরের দ্বিন প্রচারের দুঃখ-কষ্ট ও অত্যাচারের ফল দেখাবেন। অতঃপর আল্লাহতায়ালা তার রাসুল (সা.)-কে হজের অনুমতি প্রদান করেন।
নবী কারিম (সা.) অনুমতিপ্রাপ্ত হয়ে হজে গমনের ঘোষণা দেন। নবী কারিম (সা.)-এর ঘোষণা শুনে সাহাবায়ে কেরাম দলে দলে এসে সমবেত হতে থাকেন।
পবিত্র হজের উদ্দেশ্যে রওনা
হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) দশম হিজরির ২৬ জিলকদ, শনিবার জোহরের পর হজের উদ্দেশ্যে রওনা হন। রওনা হওয়ার প্রাক্কালে মাথায় তেল দেন, চুল আচড়ান, তহবন্দ পরেন, গায়ে চাদর জড়ান, কোরবানির পশু সজ্জিত করেন।
আসরের আগে জুলহুলাইফা নামক স্থানে পৌঁছেন, যেখানে দুই রাকাত নামাজ আদায় করেন। রাতযাপনের জন্য তাঁবু স্থাপন করেন। সকালে তিনি সাহাবায়ে কেরামকে বলেন, রাতে আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন আগন্তুক এসে বলেছেন, হে নবী! এ পবিত্র প্রান্তরে নামাজ আদায় করুন এবং বলুন, হজের মধ্যে উমরাও রয়েছে। -সহিহ বোখারি : ২০৭
তারপর জোহর নামাজের আগে নবী কারিম (সা.) ইহরামের জন্য গোসল করেন। উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা (রা.) নিজ হাতে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পবিত্র দেহে সুগন্ধি লাগান।
অতঃপর তহবন্দ ও চাদর পরিধান করে জোহরের দুই রাকাত নামাজ আদায় করেন। তারপর হজ ও উমরা একত্রে ইহরাম বেঁধে লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক বলে বাইরে বের হন। অতঃপর উটে আরোহণ করেন। এক সপ্তাহ পর তিনি এক বিকেলে মক্কার কাছে ‘জি তুবা’ নামক স্থানে পৌঁছেন। তখন ছিল দশম হিজরির ৪ জিলহজ, রবিবার। সাহাবায়ে কেরামের কেউ কেউ কোরবানির পশু সঙ্গে করে নিয়ে আসেন, কেউ কেউ নিয়ে আসেননি। যেসব সাহাবি কোরবানির পশু সঙ্গে করে নিয়ে আসেননি তিনি তাদের কাবাঘর তাওয়াফ, সাফা মারওয়া সাঈ শেষ করে হালাল হওয়ার নির্দেশ নেন। ৮ জিলহজ হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) মিনায় অবস্থান করেন এবং ৯ জিলহজ ঐতিহাসিক ভাষণ দেন, যা বিদায় হজের ভাষণ হিসেবে সুপরিচিত।
বিদায় হজের ভাষণ
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হাতে গড়া লক্ষাধিক সাহাবায়ে কেরাম তার সামনে উপস্থিত। সুদীর্ঘ ২৩ বছর কঠিন সংগ্রাম, অক্লান্ত পরিশ্রম, কঠোর ত্যাগ ও বর্ণনাতীত সাধনার শুভ ফল স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করে তার হৃদয় আবেগে আপ্লুত হয়ে ওঠে। অতঃপর লক্ষাধিক সাহাবায়ে কেরামের সম্মুখে তিনি তার হৃদয়বিদারক ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন।
১. হে জনতা! আমার কথাগুলো গভীর মনোযোগ দিয়ে শোনো, আমি জানি না, এবারের পর তোমাদের সঙ্গে এ জায়গায় আর একত্র হতে পারব কি না।
২. হে মানবমণ্ডলী! স্মরণ রাখো, তোমাদের আল্লাহ এক, তার কোনো শরিক নেই। তোমাদের আদি পিতা একজন, অনারবদের ওপর আরবদের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। তদ্রূপ সাদার ওপর কালোর কোনো প্রাধান্য নেই। আল্লাহ ভীতিই শুধু শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার মানদণ্ড।
৩. তোমাদের পরস্পরের রক্ত ও ধন-সম্পদ আজকের দিন, এ মাস এবং এ শহরের মতো পবিত্র।
৪. শোনো, জাহেলিয়াতের সব কিছু আমার পদতলে পিষ্ট করা হয়েছে। জাহেলিয়াতের রক্তের দাবিও রহিত করা হলো।
৫. জাহেলি যুগের সুদ রহিত করা হলো। আমাদের মধ্যকার প্রথম যে সুদ আমি রহিত করছি তা হলো, হজরত আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের সুদ। এখন থেকে সব ধরনের সুদ হারাম করা হলো।
৬. স্ত্রীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো। কেননা আল্লাহর আমানতস্বরূপ তোমরা তাদের গ্রহণ করেছ এবং আল্লাহর কলেমার মাধ্যমে হালাল করা হয়েছে। তাদের ওপর তোমাদের অধিকার রয়েছে যে তারা তোমাদের বিছানায় এমন কাউকে স্থান দেবে না, যাদের তোমরা পছন্দ করো না। তারা এরূপ করলে প্রহার করতে পারো। তবে কঠোর প্রহার করবে না। তোমাদের ওপর তাদের অধিকার হলো, তোমরা যথাযথ অন্ন-বস্ত্র প্রদান করবে।
৭. আমি তোমাদের কাছে এমন দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, যা দৃঢ়ভাবে ধারণ করলে পথভ্রষ্ট হবে না। একটি হলো আল্লাহর কিতাব আর অন্যটি হলো আমার সুন্নাহ।
৮. হে জনতা! মনে রেখো, আমার পরে কোনো নবী নেই। তোমাদের পরে কোনো উম্মত নেই। ফলে তোমাদের প্রতিপালকের ইবাদত করবে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করবে, রমজানের রোজা রাখবে, স্বেচ্ছায় ধন-সম্পদের জাকাত দেবে, আল্লাহর ঘরে হজ করবে, শাসকের আনুগত্য করবে। যদি তোমরা এসব পালন করো, তাহলে তোমাদের রবের জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে। -ইবনে মাজাহ
৯. হে মানবমণ্ডলী! পিতার অপরাধে পুত্র দায়ী হবে না এবং পুত্রের অপরাধে কোনো পিতাকে দায়ী করা হবে না।
১০. তোমাদের সঙ্গে আমার সম্পর্কের প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করা হবে। তোমরা তখন কী বলবে? সাহাবায়ে কেরাম প্রত্যুত্তরে বলেন, আমরা সাক্ষ্য দেব যে আপনি দ্বিনের দাওয়াত দিয়েছেন, আল্লাহর বাণী পৌঁছিয়ে দিয়েছেন, ন্যস্ত দায়িত্ব পালন করেছেন। নবী কারিম (সা.) এ কথা শুনে শাহাদাত আঙুল আকাশের দিকে উত্তোলন করে লোকদের দিকে ঝুঁকিয়ে তিনবার বলেন, হে রব, আপনি সাক্ষী থাকুন। -সহিহ মুসলিম
১১. প্রত্যেক মুসলমান ভাই ভাই। তোমরা তোমাদের দাস-দাসী সম্পর্কে সতর্ক থাকবে। তোমরা যা খাবে তাদেরও তা খেতে দেবে। তোমরা যা পরিধান করবে তাদেরও তা পরতে দেবে। তাদের অপরাধ ক্ষমা করে দেবে। শাস্তি দেবে না।
১২. হে মানবজাতি! ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করবে না। কেননা অতীতের অনেক জাতি এ বাড়াবাড়ির কারণে ধ্বংস হয়েছে। উপস্থিত ব্যক্তিদের দায়িত্ব হবে আমার এ কথাগুলো অনুপস্থিত লোকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
হজরত রাবিয়া ইবনে উমাইয়া ইবনে খালফ জনতার কাছে উচ্চকণ্ঠে এ বাণী পৌঁছে দেন। -ইবনে হিশাম
বিদায় হজে সাহাবির সংখ্যা
বিদায় হজে নবী কারিম (সা.)-এর সঙ্গে গমনকারী সাহাবায়ে কেরামের সংখ্যা কত ছিল এ ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। কারো মতে সাহাবায়ে কেরামের সংখ্যা ছিল এক লাখ ২৪ হাজার, কারো মতে এক লাখ ৪৪ হাজার।