মধ্য আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলীয় দেশ গ্যাবনের প্রাতিষ্ঠানিক নাম ‘গ্যাবনিজ রিপাবলিক।’ দেশটির উত্তর-পশ্চিমে রয়েছে গিনি, উত্তরে ক্যামেরুন, পূর্ব ও দক্ষিণে কঙ্গো প্রজাতন্ত্র অবস্থিত। গ্যাবনের মোট আয়তন দুই লাখ ৭০ হাজার বর্গ কিলোমিটার। উপকূলীয় সমভূমি ও পাহাড়ি ভূমির গ্যাবন প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদে যথেষ্ট সমৃদ্ধ।
দেশটির মোট অর্থনীতির ৪৬ শতাংশ আসে তেল খাত থেকে। লিব্রভিল দেশটির সর্ববৃহৎ শহর ও রাজধানী। একাধিক স্থানীয় ভাষা প্রচলিত থাকলেও গ্যাবনের দাপ্তরিক ভাষা ফ্রেন্স। গ্যাবনের জনসংখ্যা ২৬ লাখের মতো।
গ্যাবনের প্রধান ধর্ম খ্রিস্টান। পিউ রিসার্চের তথ্যমতে, মোট জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ মুসলিম। তবে এই সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। ২০৫০ সালে দেশটিতে মুসলিম জনসংখ্যার হার ১৯ শতাংশে উন্নীত হবে বলে মন্তব্য করেছে পিউ রিসার্চ।
গ্যাবনের আদিবাসী ছিল পিগমি সম্প্রদায়। পরবর্তী সময়ে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তির সহায়তায় বান্তু সম্প্রদায় পিগমিদের বিতাড়িত করে। আঠারো শতকে ‘মেইনি’ ভাষাভাষি মানুষ ‘কিংডম অব ওরোঙ্গু’ নামে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। আধুনিক গ্যাবনের ভৌগোলিক সীমা মূলত সে সময়ে নির্ণিত হয়। ‘কিংডম অব ওরোঙ্গু’ ছিল আফ্রিকার অন্যতম প্রধান দাস ব্যবসা কেন্দ্র।
১৮৭০ সালে দাস ব্যবসা বন্ধ হলে ওরোঙ্গু রাজ্যেরও পতন হয়। ১৮৮৫ সালে গ্যাবনে ফ্রান্সের আনুষ্ঠানিক ঔপনিবেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। দীর্ঘ আন্দোলন ও সংগ্রামের পর ১৯৫৮ সালে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের মর্যাদা লাভ করে এবং ১৭ আগস্ট ১৯৬০ সালে ফ্রান্সের নাগপাশ থেকে পুরোপুরি স্বাধীনতা লাভ করে।
ধারণা করা হয়, খ্রিস্টীয় একাদশ শতকে মরক্কোর ধর্মপ্রচারকদের মাধ্যমে গ্যাবনে ইসলামের যাত্রা শুরু হয়। এ সময় মরক্কোর ইসলাম প্রচারকরা আফ্রিকার উপকূলীয় অঞ্চলে চষে বেড়ান। খ্রিস্টীয় ১৫ শতকে গ্যাবনের ‘ফাঙ্গ’ গোত্র ইসলাম গ্রহণ করে। এরপর মালি, নাইজার প্রভুতি মুসলিম দেশ থেকে আগত ব্যবসায়ীদের প্রচেষ্টায় ক্যামেরুনের ‘ফুলানি’ গোত্র ইসলাম গ্রহণ করে। যাদের একাংশ গ্যাবনেও বসবাস করে। তারাও গ্যাবনে ইসলাম প্রচারে ভূমিকা রাখে।
তবে ১৯৭৩ সালে দেশটির প্রেসিডেন্ট অ্যালবার্ড বার্নার্ড বানগো ইসলাম গ্রহণের পর গ্যাবনবাসীর মধ্যে ইসলাম গ্রহণের হার বৃদ্ধি পায়। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস গ্যাবনের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। কেননা, এ মাসেই গ্যাবনের প্রেসিডেন্ট অ্যালবার্ড বার্নার্ড বানগো ইসলাম গ্রহণ করেন। অ্যালবার্ডের ইসলাম গ্রহণ উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এ অনুষ্ঠানে ‘মুসলিম ওয়ার্ল্ড লিগের’ একটি প্রতিনিধিদল অংশগ্রহণ করে।
তারা বার্নার্ডকে পবিত্র কোরআনের একটি কপি এবং কাবার গিলাফ দিয়ে সম্মানিত করেন। এর সঙ্গে ছিল পবিত্র জমজমের পানি এবং মদিনার সুস্বাদু খেজুর। এ উপলক্ষে মুসলিম ওয়ার্ল্ড লিগের মহাসচিব অ্যালবার্ড বার্নার্ডকে এক তারবার্তা প্রেরণ করেন এবং ইসলাম গ্রহণের জন্য তাকে আন্তরিকভাবে অভিনন্দন জানান।
প্রেসিডেন্ট অ্যালবার্ড বার্নার্ড বানগোর ইসলাম গ্রহণের ঘটনাটি বেশ চিত্তাকর্ষক। এটা একটা ইতিহাস হয়ে আছে। তার সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেক গণ্যমান্য ও বিশিষ্ট ব্যক্তি ইসলাম ধর্ম কবুল করেন। অ্যালবার্ড বার্নার্ড বানগো ‘ওমর বানগো’ নাম ধারণ করেন।
মধ্য আফ্রিকান দেশ গ্যাবনে ১৯৬৭ সালে মাবা সাত বছরের জন্য পুনরায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন। অ্যালবার্ড বার্নার্ড ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। মাবা ওই বছরের নভেম্বরে মারা যান।
তখন মাত্র ৩১ বছর বয়সে অ্যালবার্ড বার্নার্ড প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৬৮ সালের ১২ মার্চ তিনি একমাত্র পার্টিভিত্তিক এক সংবিধান ঘোষণা করেন। তিনি ২ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং ১৯৭৯ সাল ও ১৯৮৬ সালেও তিনি এ পদে পুনর্নির্বাচিত হন। ২০০৯ সালের ৮ জুন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্রপতি ছিলেন। সে হিসেবে তিনি ৪২ বছরের বেশি সময় দেশটি শাসন করেছেন।
অ্যালবার্ড বার্নার্ড ১৯৫৯ সালে জসপাইন কামাকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর তিনি তার স্ত্রীর ধর্ম ক্যাথলিকের প্রতি অনুরক্ত হন, যদিও তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে খ্রিস্টান হননি। পরে তিনি লিবিয়ার প্রেসিডেন্টের উৎসাহে ১৯৭৩ সালে ইসলাম গ্রহণ করেন। তারপর তিনি পবিত্র মক্কায় হজব্রত পালন করেন। ১৯৭৮ সালের এপ্রিলে তিনি ছয় দিনের এক সফরে সৌদি আরবের রাজধানীতে গমন করেন। এ সময় বাদশাহ খালেদ বিন আবদুল আজিজের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়।
ওমর বানগোর নেতৃত্বে গ্যাবনে আন্তর্জাতিক মুসলিম সহযোগিতা সংস্থা ওআইসিতে যোগদান করে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ফিলিস্তিনের মতো মুসলিম ইস্যুতে গ্যাবন সাধারণত মুসলিম সম্প্রদায়কে সমর্থন দিয়ে থাকে।
আফ্রিকার অন্যান্য অমুসলিম দেশের তুলনায় গ্যাবনের মুসলিমরা বেশি ধর্মীয় স্বাধীনতা উপভোগ করে। সেখানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমতি সাপেক্ষে মুসলিমরা পৃথক ইসলামি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল পরিচালনার সুযোগ পায়, দুই ঈদসহ ধর্মীয় দিবসে ছুটি কাটাতে পারে, সরকারি প্রচার মাধ্যমে অনুষ্ঠান সম্প্রচারের সুযোগ পায়, সরকারি চাকরিতে যোগদান করতে পারে।
২০০৪ সালে গ্যাবনের মুসলিমরা প্রথমবারের মতো লিব্রভিলে প্রথম জাতীয় সম্মেলন করে। সম্মেলনে দেশটির ৩৪টি মুসলিম সম্প্রদায় ইসলামের স্বার্থে একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার করে।