পৃথিবীর হৃৎপিণ্ড মক্কা মুকাররামা

মক্কা, ইসলাম

সাঈদ চৌধুরী, অতিথি লেখক, ইসলাম | 2023-09-01 20:27:35

মক্কা মুকাররামায় অবস্থিত পবিত্র কাবা ঘরকে পৃথিবীর হৃৎপিণ্ড কিংবা হৃদয় বলা যায়। ভৌগলিক অবস্থানের দিক থেকে দুনিয়ার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত। গোল্ডেন রেশিও তথা গোলাকার পৃথিবীর মধ্যস্থলে কাবা ঘরের অবস্থান। একে কেন্দ্র করে পৃথিবী ঘূর্ণায়মান।

বৈজ্ঞানিকভাবে আমরা জানি, বছরের একটি বিশেষ মধ্যাহ্নে সূর্য কাবা শরিফের ঠিক ওপরে অবস্থান করে। তখন কাবা ঘরে অন্যকোনো স্থাপনার ছায়া চোখে পড়ে না। পৃথিবীর অন্যত্র এমনটা ঘটে না। এতে প্রমাণিত হয়, পবিত্র কাবা ভূমণ্ডলের ঠিক মধ্যস্থলে অবস্থিত।

চন্দ্র-সূর্য কিংবা তারকারাজি মহাবিশ্বের সবকিছুই মহান আল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন। একমাত্র তার নির্দেশেই পরিচালিত হচ্ছে। বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় এটাকে মাধ্যাকর্ষণ বলে, আর ইসলামি পরিভাষায় বলা হয়, স্রষ্টার প্রতি সৃষ্টির নিঃসঙ্কোচ আনুগত্য ও আত্মসমর্পণ।

১৯৮৫ সালের রমজান মাসে সৌভাগ্যক্রমে মহান আল্লাহর ঘর পবিত্র মক্কায় গিয়ে হাজির হই। সঙ্গে ছিলেন বড় ভাই ডা. শাব্বির আহমদ চৌধুরী ও সেজ ভাই মাওলানা ফায়্যাজ আহমদ চৌধুরী। এরপর বহুবার গিয়েছি। কিন্তু ভালোলাগা ও ভালোবাসায় কোনো ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়নি। সে এক গভীর অনুভূতি। কাবা ঘরের মন মাতানো সুরভি-সৌরভমণ্ডিত, কী ঔজ্জ্বল্য আলোর দীপ্তি! এমন সুন্দরতম ও চিত্তাকর্ষক স্থান পৃথিবীতে আর নেই।

মহান আল্লাহর ঘরের দিকে তাকিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। মহান মাবুদের প্রতি পূর্ণ অনুগত হয়ে বারবার উচ্চারণ করেছি, হে আল্লাহ! আমি হাজির, আমাকে দয়া করে তোমার প্রিয় বান্দাদের শামিল করে নাও।

লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা-শারিকা লাকা লাব্বাইক। ইন্নাল হামদা ওয়ান্নিমাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা-শারিকা লাক। আমি হাজির, ও আল্লাহ! আমি হাজির। তোমার কোনো শরিক নেই। সব প্রশংসা ও নেয়ামত শুধুই তোমার। সাম্রাজ্য তোমারই। তোমার কোনো অংশিদার নেই।

মহান আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও শান-শওকতের সামনে আমি নতজানু। দুনিয়ার জালেম শাসক ও স্বৈরাচারী শক্তিসমূহকে অস্বীকার করছি। অস্বীকার করছি আল্লাহ ছাড়া সকল প্রভুত্বের দাবিদার তাগুতি শক্তির ঔদ্ধত্যকে।

আমার হৃদয়ধ্বনি কাবার গিলাফ ছাপিয়ে যেন বাতাসে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ডানে-বায়ে ও সামনে-পেছনে যারা আছেন, তারা সবাই এক কাপড়ে আবৃত। ধনী-গরিব আর সাদা-কালোর কোনো তফাৎ নেই। সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ।

আমাদের তালবিয়া উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে আরও অসংখ্য মানুষের সু-উচ্চকণ্ঠ নিনাদে মহান আল্লাহর একত্ব ও মহত্ত্বের কথা বিঘোষিত হচ্ছে।

কেয়ামতের ময়দানে আল্লাহর সামনে যেভাবে হাজির হব, সেভাবে আমরা হাজির হয়েছি। আল্লাহর প্রতি হৃদয় নিংড়ানো গভীর ভালোবাসার আবেগকেন্দ্রিক মুহূর্ত। সকলে আল্লাহর ঘর তওয়াফরত। কাবার চারদিকে প্রদক্ষিণ করে হাজরে আসওয়াদে চুমু খেয়ে অন্তরাত্মায় জাগরিত হয় বেহেশতি আবহ অনুভূতি মিশ্রিত প্রশান্তি। পবিত্র কাবা ঘরের দিকে দুই হাত তুলে বার বার প্রাণভরে উচ্চারণ করেছি আকুতি ভরা প্রণতি ‘আল্লাহু আকবর’, আল্লাহই সর্বশ্রেষ্ঠ।

কাবাঘর কেবল ইবাদতকেন্দ্র নয়। এটি মানুষের জন্য সুপথ প্রদর্শনের ও বরকত দানের প্রথম ঘর। কোরআনে কারিমের দৃষ্টিতে এই ঘর মুসলমানদের ঐক্য ও নিরাপত্তার কেন্দ্র। মুশরিক ও কাফেরদের বাধার কারণে মক্কা ছেড়ে মদিনায় যেতে বাধ্য হয়েছিলেন মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। পরিস্থিতির পরিবর্তন হলে বিশ্বনবী একতা ও সংহতির ডাক দিয়ে মক্কায় আসেন।

মিকাতে গোসল সেরে তিনি ইহরামের পোশাক পরলেন। এরপর গভীর প্রেম ও অপূর্ব ভঙ্গিমায় তালবিয়ায় মহান আল্লাহর প্রশংসা ও শ্রেষ্ঠত্বের কথা উচ্চারণ করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। পবিত্র কাবাঘরের সামনে এসে দুই হাত ওপরে তুলে দোয়া করলেন- হে আল্লাহ! এই ঘরের মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব ও কল্যাণ বাড়িয়ে দিন। আর যারা ওমরা ও হজ করতে আসবে তাদের সম্মান ও কল্যাণ বাড়িয়ে দিন। এরপর তিনি হাজরে আসওয়াদ পাথরে হাত বুলালেন এবং কাবার চারদিকে প্রদক্ষিণ করলেন।

মহানবী (সা.) মদিনা থেকে মক্কায় উটে চড়ে এসেছিলেন। তার উটের চালক হজরত আবদুল্লাহ বিন রাওয়াহা কবিতা আবৃত্তি করে বলছিলেন, হে মুশরিক ও কাফিরদের সন্তানেরা, মহনবীর জন্য পথ খুলে দাও। তোমরা জেনে রাখো, তিনি সব কল্যাণের উৎস, তাকে মেনে নেওয়া ও তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের মধ্যেই কেবল কল্যাণ নিহিত। হে প্রভু! আমি তার বাণীতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি এবং তার রেসালাতে বিশ্বাস স্থাপন সংক্রান্ত আপনার নির্দেশ সম্পর্কেও আমি জ্ঞাত।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘সুদূর মক্কা মদিনার পথে আমি রাহি মুসাফির/বিরাজে রওজা মোবারক যথা মোর প্রিয় নবীজীর/ বাতাসে যেখানে বাজে অবিরাম/ তৌহিদ বাণী খোদার কালাম/ জিয়ারতে যথা আসে ফেরেশতা শত আউলিয়া পীর/ মা ফাতেমা আর হাসান হোসেন খেলেছে পথে যার/ কদমের ধূলি পড়েছে যেথায় হাজার আম্বিয়ার/ সুরমা করিয়া কবে সে ধূলি/ মাখিব নয়নে দুই হাতে তুলি/ কবে এ দুনিয়া হতে যাবার আগে রে কাবাতে লুটাব শির।’

লেখক: লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক। কবি ও কথা সাহিত্যিক।

 

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর