দোষ আড়াল করে রাখা আল্লাহতায়ালার অন্যতম অনুগ্রহ ও দান। এটা ছাড়া কিছুতেই মানুষের জীবন সুন্দর হয় না। এর ছায়াতলে থাকা ব্যতীত মন সুখী হয় না। দোষ ঢেকে রাখাটা শোভা ও সৌন্দর্য, উজ্জ্বলতা ও মহত্ত্ব। জাতি এর মাধ্যমে নিজের কাঠামো, সংহতি ও ভিত্তি রক্ষা করে। দোষ আড়াল করে রাখার অর্থ হলো- কথায় ও কাজে, বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণভাবে দোষত্রুটি ঢেকে রাখা, ব্যর্থতা-তুচ্ছতা গোপন করা ও মন্দত্ব-স্খলন লুকিয়ে রাখা। আমাদের প্রতিপালক এ মহান গুণে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত, কেননা তিনি হলেন শ্রেষ্ঠতম গোপনীয়তা রক্ষাকারী। সুনানে আবু দাউদে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ লজ্জাশীল, দোষ গোপনকারী।’
হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে তিনি অপছন্দ করেন এমন কিছুর সংবাদ গেলে তিনি এড়িয়ে যেতেন, তা স্পষ্ট করে প্রকাশ করতেন না। গোপন রাখতেন, তা ফাঁস করতেন না। তিনি বলেন, ‘সেসব লোকের কী অবস্থা যারা এমন এমন বলে?’ হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক লোক নবী করিম (সা.)-এর কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসুল, আমি শহরের দূরতম প্রান্তে এক নারীর সঙ্গে মেলামেশা করেছি এবং তার সঙ্গে আমার সহবাস করা ছাড়া সবই হয়েছে। আমি উপস্থিত, আমার বিষয়ে যা আপনার ইচ্ছা হয় বিচার করেন। তখন হজরত ওমর (রা.) তাকে বললেন, আল্লাহ তোমার বিষয়টি গোপন রেখেছেন, যদি তুমি নিজেকে গোপন রাখতে! এ কথায় নবী করিম (সা.) কোনো বাধা দেননি। তখন লোকটি উঠে চলে গেল। তারপর নবী করিম (সা.) আরেকজন লোক পাঠালেন তাকে ডেকে আনতে এবং এ আয়াতটি পাঠ করলেন, ‘দিনের দুই প্রান্তিক সময়ে ও রাতের প্রথম ভাগে নামাজ আদায় কর। নিশ্চয় ভালো কাজগুলো মন্দ কাজগুলোকে দূর করে দেয়। এটা জিকিরকারীদের জন্য উপদেশ।’ -সুরা হুদ : ১১৪
তখন গোত্রের এক লোক দাঁড়িয়ে বলল, হে আল্লাহর রাসুল, এটা কি তার জন্যই বিশেষভাবে নির্দিষ্ট? তিনি বললেন, ‘বরং সব মানুষের জন্যই।’ –সহিহ মুসলিম
সাহাবায়ে কেরাম দোষত্রুটি আড়াল করা এবং পাপ-স্খলন গোপন করার ক্ষেত্রে পাপী ও অন্যায়কারীদের সঙ্গে আচরণ বিষয়ে নবী করিম (সা.)-এর দিকনির্দেশনা সঠিকভাবে অনুধাবন করেছেন। ইবনে আবি শায়বা স্বীয় গ্রন্থে বর্ণনা করেন, ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) বলেছেন, ‘আমি যদি কোনো মদপানকারীকে ধরি, তবে আমি চাইতাম আল্লাহ তাকে গোপন করে রাখেন। আর আমি যদি কোনো চোরকে ধরি, তবে আমি চাইতাম আল্লাহ তাকে আড়াল করে রাখেন।’
দোষ গোপন রাখার সবচেয়ে বড় দৃশ্য হলো যেদিন আল্লাহ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে সব মানুষকে একত্র করবেন, যেখানে আল্লাহর রহমত প্রতিভাত হবে। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ মোমিন বান্দাকে কাছে নিয়ে তার ওপর নিজের ছায়া রাখবেন, তাকে আড়াল করবেন, তারপর বলবেন, তুমি কি অমুক গোনাহর কথা জান? তমুক পাপের কথা জান? সে বলবে, হে আমার রব, হ্যাঁ। এভাবে যখন সে নিজের পাপ স্বীকার করবে এবং মনে করবে যে, সে ধ্বংস হয়ে গেছে। তখন আল্লাহ বলবেন, আমি দুনিয়াতে তোমার পাপ আড়াল করেছিলাম, আজ আমি তোমার জন্য তা ক্ষমা করে দিলাম, তারপর তার ভালো কাজের আমলনামা দেওয়া হবে।’ -সহিহ বোখারি
যে লোক নিজের দোষ গোপন রেখে আপন রবের দরবারে তওবা করে, আল্লাহর তা আড়াল করার আশা নিয়ে এবং তাকে ক্ষমা করার আকাঙ্খা পোষণ করে সেই লোকের জন্য আল্লাহর রহমতের বরং আরও বড় দৃষ্টান্ত হলো, তিনি নিজের অনুগ্রহে ও দয়ায় তার মন্দ কাজগুলোকে পুণ্যে পরিবর্তন করে দেবেন।
সুন্দর করে অন্যের দোষ গোপন করে রাখা মনুষ্যত্ব, বিশ্বস্ততা, উদারতা ও ভ্রাতৃত্বের পরিচয়। সুন্দর আচরণের পরিচয়বাহী এমন দোষ ঢেকে রাখার দৃষ্টান্ত হলো স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার দোষ আড়াল করে রাখা। আল্লাহ বলেন, ‘তারা তোমাদের জন্য পোশাক ও তোমরা তাদের জন্য পোশাকস্বরূপ।’ -সুরা বাকারা : ১৮৭
জীবনের মধুর লগ্নে, তিক্ততায়, দুঃসময় ও সুখের লগ্নে উভয়ে আরেকজনের জন্য পর্দার আচ্ছাদন ও শোভা, ভালোবাসা, মমতা ও পূর্ণতার প্রতীক। তারা খুশি-আনন্দ ভাগাভাগি করবে, দুঃখ-বেদনা বণ্টন করে নেবে। তাই ভালোবাসা, দয়া ও কঠোর অঙ্গীকারের পরে একে অপরের গোপনীয়তা ফাঁস করে দেওয়া সমীচীন নয়।
দোষ গোপন রাখার উপকারিতা বিশাল। ভালোবাসা ও সৌহার্দ্য বিস্তার, মুসলমানদের মধ্যে সুধারণা সৃষ্টি, পাপী লোককে নিজেকে সংশোধন করতে এবং নিজ রবের কাছে তওবা করতে সহযোগিতা ইত্যাদি। দোষ গোপন রাখার গুরুত্বের কারণেই আল্লাহ মন্দকর্মের প্রচার ও ধ্বংসাত্মক বিষয়াদির প্রসার অপছন্দ করেন। যারা এমন কাজ করে তাদের দুনিয়া ও আখেরাতে শাস্তির হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
অশ্লীল বিষয়াদি বিস্তার লাভ করুক এটা মনে মনে কামনা করা ও তাতে আনন্দিত হওয়াতেই যদি এত কঠোর হুঁশিয়ারি থাকে, তবে যারা তা সরাসরি প্রচার করে তাদের অবস্থা কেমন দাঁড়াবে? ইমাম বোখারি (রহ.) এর আল-আদাবুল মুফরাদে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি কোনো অশ্লীলতার কথা শুনে তা প্রচার করে দিল, সে লোক তাতে ওই লোকের মতো জড়িত হয়ে পড়ল, যে তা সরাসরি করেছে। এর চেয়েও মারাত্মক হলো, এর দ্বারা সে নিজেকে আল্লাহর ক্ষমা থেকে ছিটকে ফেলল।
হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমার পুরো উম্মত ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে, তবে পাপের প্রচারকারীরা ছাড়া। আর পাপের প্রচারণার দৃষ্টান্ত হলো, ব্যক্তি রাতে কোনো পাপ করে সকাল হলে বলবে, হে অমুক, আমি তো গতরাতে এমন এমন কাজ করেছি, অথচ আল্লাহ তা গোপন রেখেছিলেন। তার রব রাতে তা আড়াল করে রাখলেন, আর সে সকালে আল্লাহর পর্দা ফাঁস করে দিল।’
আল্লাহ কর্তৃক বান্দার দোষ গোপন করে রাখার সবচেয়ে বড় উপায় হলো, বান্দা নিজেকে খাঁটি ও আন্তরিক রাখার সর্বাত্মক সাধনা করবে। যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য কথায়-কাজে নিষ্ঠাবান হয়, আল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাতে তার দোষ ঢেকে রাখেন। আর যে নিজের আমলের দ্বারা যশ, খ্যাতি, সুনাম, প্রশংসা চায় আল্লাহ তার প্রতি ক্রুদ্ধ হন, মানুষকে তার মনের নষ্টামির কথা জানিয়ে দেন। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে অন্যকে শোনাতে চায়, আল্লাহ তার দোষ শুনিয়ে দেন। যে লোক দেখাতে চায়, আল্লাহ লোকদের তার দোষ দেখিয়ে দেন।’ -সহিহ বোখারি
আল্লাহ কর্তৃক বান্দার দোষ গোপন রাখার আরেকটি বড় উপায় হলো, বান্দা অন্যদের দোষ গোপন রাখার গুণে ভূষিত হবে। যেমন কর্ম তেমন প্রতিদান হবে। তাই যে তার ভাইদের দোষ আড়াল করতে সচেষ্ট হবে, আল্লাহ আরও কঠিনতম পরিস্থিতিতে তার দোষ গোপন রাখবেন, যখন আল্লাহর দোষ করার প্রতি ও তার ক্ষমার প্রতি তার প্রয়োজন খুব বেশি হবে। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের দোষ গোপন করল, আল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাতে তার দোষ গোপন করবেন।’ –সহিহ বোখারি