মক্কা মোকাররমা (সৌদি আরব) থেকে: যার হাত ধরে ‘লাগেজ’ এসেছিলো- সৌদি আরবে, সেই ‘লাগেজ’ দেশে ফিরছে ‘সঙ্গীহীন’ হয়ে! ওই লাগেজের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মক্কা-মদিনার অসংখ্য স্মৃতি। চিরন্তন সত্য ‘মৃত্যু’ এসব লাগজকে করেছে আবেগমাখা ও স্মৃতিময়। বাংলাদেশ থেকে আসা ১৩৩ জন হাজীর লাগেজ এভাবেই সঙ্গীহীন হয়ে ফিরছে নিজ দেশে।
এখন পর্যন্ত হজপালনে সৌদি আরব এসে ইন্তেকাল করেছেন ১৩৩ জন হজযাত্রী। যাদের মধ্যে ১১২ পুরুষ জন, ২১ জন নারী। মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে মক্কায় ৮৩, মদিনায় ১৭, জেদ্দায় ৫, মিনায় ১৮ ও আরাফাতের ময়দানে ইন্তেকাল করেছেন ১০ জন। সর্বশেষ পবিত্র মক্কায় ইন্তেকাল করেছেন গাইবান্ধার মো. ফজলার রহমান (৬৬)। তার পাসপোর্ট নম্বর- BT0042897।
হজপালনে এসে মৃত্যুবরণকারী হাজীদের কেউ এসেছিলেন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। আবার কেউবা এলাকার পরিচিতজনদের সঙ্গে। রীতি অনুযায়ী হজপালনে এসে মৃত্যুবরণকারীদের দাফন করা হয় সৌদি আরবে। মক্কায় ইন্তেকাল করলে মক্কার শরায়া কবরস্থানে আর মদিনা শরীফ ইন্তেকাল করলে বাকী কবরস্থানে।
বাংলাদেশ হজ মিশনের কাউন্সিলর (হজ) মুহাম্মাদ মাকসুদুর রহমান জানান, মৃত্যু এক অমোঘ সত্য বিষয়। এখানে ইন্তেকাল করা হাজীদের মৃতদেহ দেশে নেওয়ার জন্যে স্বজনদের অনেকেই মিশনে আসেন। তারা আমাদের কাছে বলেন, দেশে তার স্বজনরা শেষ বিদায় জানাতে মরদেহ দেশে নিতে চান। তবে মৃতদেহ এখান থেকে দেশে পাঠানো অত্যন্ত জটিল। তাই চলতি হজ মৌসুমে ইন্তেকাল করা হাজীদের দাফন করা হয়েছে পবিত্র ভূমিতেই। তবে মৃত্যু পরবর্তী প্রক্রিয়া হিসেবে আমরা ইন্তেকাল করা হাজীদের পাসপোর্ট ও মৃত্যু সনদ পাঠিয়ে দিচ্ছি ঢাকায়। সেখানে মৃতের উত্তরাধিকারদের যথাযথ প্রমাণ দিয়ে তা গ্রহণ করার জন্যে ঢাকার হজ অফিসে যোগাযোগ করতে হবে।
হজ মিশনের একজন কর্মকর্তা জানান, তার ব্যাচের এক পুলিশ কর্মকর্তা বাবাকে হজে পাঠিয়েছিলেন। দাফনের পূর্বে ইমোতে যখন তার বাবার ছবিটা পাঠাচ্ছিলাম তখন বুকটা খা খা করছিলো! পানি ধরে রাখতে পারিনি। আরও কষ্টের ছিলো- যখন লাগেজগুলো পাঠাচ্ছিলাম।
সৌদি প্রবাসী সাংবাদিক আল আমীন জানান, হাজীদের কেউ মারা গেলে সঙ্গে থাকা স্বজন বা সহযাত্রীদের অশ্রুসিক্ত হৃদয়ে যখন শেষ বিদায় জানাতে যান, তখন মনে হয় মৃত্যুটাই সত্য। যেটা আমরা প্রায় সময়ই ভুলে থাকি।
তিনি বলেন, আমরা ভুলে যাই; জীবন-মৃত্যুর খুব কাছাকাছি অবস্থান করেও আমার মৃত্যুকে ভুলে থাকি।
রাজবাড়ী সদরের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত কৃষি কর্মকর্তা ফজলুল হক স্ত্রী রেবেকা সুলতানাকে নিয়ে হজে এসেছিলেন ৭ আগষ্ট। মদিনা আসেন ৭ সেপ্টেম্বর। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে ১২ সেপ্টেম্বর রাতে তাকে ভর্তি করা হয় কিং ফাহাদ হাসপাতালে। সেখানে তার হার্টে ৩টা রিং পড়ানো হয়। ১৬ সেপ্টেম্বর বিকেলে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হলে তিনি মদিনার হজ মিশনে কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেশে ফেরার জন্যর নিজের সব প্রস্তুতির কথাও জানান। কিন্তু ওইদিন রাত ১১টার দিকে তিনি চলে যান না ফেরার দেশে। দেশে ফেরার প্রস্তুতির মুহূর্তে স্বামীর এমন মৃত্যুর জন্যে মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না তিনি।
এখন মদিনা থেকে স্বামীকে ছাড়াই রেবেকাকে ফিরে যেতে হবে বাংলাদেশে। দুই সন্তান, আত্নীয়-স্বজন ও পরিবার-পরিজনকে তিনি কি করে বোঝাবেন দীর্ঘদিনের দাম্পত্যসঙ্গীর শূন্যতার কথা!
হজ মিশনের কর্মকর্তারা বলেন, কি করেই তাকে সান্ত্বনা দেবো আমরা! বিশ্বাস করুন, তার অসহায় মুখ দেখলে কষ্টে হৃদয় ভেঙে আসে। তবে এটাই সত্য সবাইকে এভাবেই চলে যেতে হয়।
এতসব কিছুর মাঝে অনেকের কাছে এটাও তৃপ্তির বিষয়। মানুষটা নেই সত্য, কিন্তু লাগেজটা দেশে ফিরে যাচ্ছে পবিত্র ভূমি থেকে সেই মানুষটির স্মৃতি নিয়ে।