সৃষ্টির সেরা বা ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ হিসেবে যার মানসম্মান আর হুঁশ আছে সেই মানুষ। বিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন জীবই মানুষ। আবার বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষকেই মনে করা হয় সবচেয়ে বেশি অবিবেচক, অত্যাচারী, নির্যাতনকারী কিংবা নির্যাতনভোগী। মানুষ দুঃখ-কষ্ট, বালা-মুসিবত, মহামারি কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগকে যতটা না ভয় পায়; তারচেয়ে বেশি ভয় পায় দুষ্ট লোককে।
আর এ কারণেই মানুষের ব্যক্তিগত আমল অনুযায়ী পরকালে তার স্থান নির্ধারিত হবে। যার আমল যত ভালো হবে, তার সম্মান, মর্যাদা তত উন্নত ও উচ্চমার্গের হবে। হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছু মানুষকে উত্তম মানুষ বলেছেন। তারা হলেন-
এক. হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ওই ব্যক্তি, যে তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম আচরণের অধিকারী।’ –সহিহ বোখারি: ৬০৩৫
দুই. নবী করিম (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ওই ব্যক্তি, যে নিজে কোরআন শেখে এবং অন্যকে শেখায়।’ –সহিহ বোখারি: ৫০২৭
তিন. হজরত রাসূলে কারিম (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ওই ব্যক্তি, যার কাছ থেকে সবাই কল্যাণ আশা করে, অনিষ্টের আশঙ্কা করে না।’ –সুনানে তিরমিজি: ২২৬৩/২৪৩২
চার. নবী করিম (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ওই ব্যক্তি, যে তার পরিবারের কাছে ভালো।’ -সহিহ ইবনে হিব্বান: ৪১৭৭
পাঁচ. নবী করিম (সা.) হাদিসে বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সর্বসেরা ব্যক্তি সে, যে ঋণ পরিশোধের বেলায় ভালো।’ –সহিহ বোখারি: ২৩০৫
ছয়. মহানবী (সা.) বলেন, ‘সেরা মানুষ সে, যার বয়স দীর্ঘ এবং কর্ম ভালো হয়।’ -জামিউল আহাদিস: ১২১০১
সাত. হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সর্বোত্তম মানুষ সে ব্যক্তি, যে মানবতার জন্য অধিক কল্যাণকর ও উপকারী।’ -সহিহুল জামে: ৩২৮৯
আট. নবী করিম (সা.) বলেন, ‘শ্রেষ্ঠ মানুষ হলো- যার অন্তর পরিচ্ছন্ন ও মুখ সত্যবাদী। সাহাবিরা জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসূল! সত্যবাদী মুখ বোঝা গেল, কিন্তু পরিচ্ছন্ন অন্তরের অধিকারী কে? রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, যে অন্তর স্বচ্ছ ও নির্মল, মুত্তাকি যাতে কোনো পাপ নেই, বাড়াবাড়ি নেই, খেয়ানত ও বিদ্বেষ নেই।’ -সহিহুল জামে: ৩২৯১
নয়. হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি সে, যার চরিত্র সবচেয়ে বেশি সুন্দর।’ –সহিহ বোখারি: ৩৫৫৯
দশ. নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহর কাছে সর্বোত্তম সঙ্গী সে, যে তার সঙ্গীর কাছে উত্তম। আর আল্লাহর কাছে সর্বোত্তম প্রতিবেশী সে, যে তার প্রতিবেশীর কাছে উত্তম।’ –সুনানে তিরমিজি: ১৯৪৪
বর্ণিত হাদিসগুলোর আলোকে যদি কোনো মানুষ নিজেকে বিচার করে, তাহলে সে নিজেই অনুধাবন করতে সক্ষম হবে, সে কতটা সত্যিকারের মানুষ। এ কথা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, বিজ্ঞানের আশীর্বাদে আমরা সভ্যতার চরম শিখরে অবস্থান করছি; তবু ‘যত সভ্য হচ্ছি, ততই যেন অসভ্য হচ্ছি।’ তাই আজ ‘মানুষ মানুষকেই বড্ড বেশি ভয় পায়।’
দুর্বলের প্রতি সহিসংতা, খুন, মারামারি, জোর-জবরদস্তি, যুদ্ধ আর হানাহানি দেখলে মানুষ হিসেবে নিজেকে শুধু অসহায়ই মনে হয় না, অপরাধীও মনে হয়। তার পর যখন দেখি আমাদের চারপাশের কিছু লোক তাদের চেষ্টা, সততা, সত্যনিষ্ঠা, দায়িত্ব ও মেধা দ্বারা নিরন্তর অন্য মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছেন তখন আশায় বুক বাঁধি। ভরসা পাই এই ভেবে, এখনও কিছু মানুষ আছেন যারা শুধু দেহসত্তা নয়, বোধসত্তায়ও সমুজ্জ্বল।
বিশ্বলোকের বিশালতার তুলনায় মানুষ অত্যন্ত ক্ষুদ্রকায়, সংকীর্ণ সীমাবদ্ধ বয়সের এ মানুষই অন্তর্নিহিত সত্তার দিক দিয়ে বিরাট, বিশাল ও মহান। মানুষের মাঝে অধঃগামিতা, ভোগবাদিতা, হিংসা, পাশবিকতা, নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতা যেমন আছে তেমনি রয়েছে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, সংযম, নম্রতা, বিনয়, নৈতিকতা, বন্ধুত্ব ও পবিত্রতা।
পরিবার হলো আদর্শ, ভাবধারা, দৃষ্টিভঙ্গি গঠনের কেন্দ্রবিন্দু। যার কেন্দ্রে অবস্থান করে মা-বাবা আর পরিধির দিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে সন্তানরা। মানবীয় স্তরের মূল্যবোধগুলো বিভিন্ন ঘটনা, দুর্ঘটনা, ভাঙা-গড়ার পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়ায় তৈরি করে ব্যক্তিত্ব যা শিশুর মন-মানস ও চরিত্র গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
শিক্ষা মানুষকে বিবেকবোধ সম্পন্ন মানুষ হয়ে উঠতে সাহায্য করে। শিক্ষা মানব অন্তরে সুকুমারবোধই জাগ্রত করে না, সেই সঙ্গে কোনটি ভুল আর কোনটি শুদ্ধ সেই বিবেচনাশক্তিও জাগ্রত করে। তাই তো মহানবী (সা.) সর্বদা সন্তানদের উত্তম শিক্ষা দেওয়ার কথা বলেছেন।
সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিক্ষার দু’টো ধারা প্রবাহমান- সুশিক্ষা ও কুশিক্ষা। এজন্য আমাদের স্লোগান হোক- ‘সুশিক্ষায় শিক্ষিত হোক সমগ্র মানবজাতি।’