স্যার জেমস স্টুয়ার্টের মতে, অর্থনীতি এমন এক শাস্ত্র; যা এক ব্যক্তি সমাজের একজন হওয়ার দিক দিয়ে কিরূপ দূরদৃষ্টি ও মিতব্যয়িতার সঙ্গে নিজ ঘরের যাবতীয় প্রয়োজন পূর্ণ করতে পারে তা আমাদেরকে বলে দেয়।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ মার্শাল বলেন, অর্থনীতি মানুষের জীবনের সাধারণ কার্যাবলির পর্যালোচনা মাত্র। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ কেয়ার্নক্রমের মতে, সমাজের সাধারণ মানুষের সর্ববিধ প্রয়োজন অনুসারে পণ্যের উৎপাদন, উৎপন্ন পণ্যের সুবিচারপূর্ণ বণ্টন এবং উৎপাদনের উপায় ও এর সঠিক বণ্টনের ন্যায়নীতি সম্পন্ন প্রণালী নির্ধারণ করাই হচ্ছে অর্থনীতির কাজ।
ইসলামি অর্থনীতির সংজ্ঞা এসব থেকে ভিন্ন। মাওলানা হিফজুর রহমান (রহ.) বলেন, শরিয়তের পরিভাষায় যে বিদ্যা বা জ্ঞানের মাধ্যমে এমন সব উপায় সম্বন্ধে জ্ঞাত হওয়া যায় যার দ্বারা ধন-সম্পদ আহরণ ও ব্যয়ের উপযুক্ত ও সঠিক পন্থা এবং বিনষ্ট হওয়ার প্রকৃত কারণ নির্দেশ করা হয়, তাকে ইসলামি অর্থনীতি বলা হয়।
সূরা বাকারায় আল্লাহতায়ালা বলছেন, ‘আল্লাহতায়ালা ক্রয়-বিক্রয়, ব্যবসা-বাণিজ্য হালাল করেছেন কিন্তু সুদ ও সুদভিত্তিক যাবতীয় কারবার হারাম ঘোষণা করেছেন।’
আল্লাহতায়ালা অন্যত্র বলেন, ‘মুসলমানগণ, তোমরা অন্যায়ভাবে অসদুপায়ে পরস্পরের ধন-সম্পদ ভক্ষণ করো না। তোমাদের পারস্পরিক সম্মতিক্রমে ব্যবসা-বাণিজ্যের মারফতই অর্থের আদান-প্রদান করো।’
নবী করিম (সা.) সুদ সম্পর্কে যে হাদিস বর্ণনা করেছেন, তা হচ্ছে- ‘হজরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) সুদদাতা, সুদগ্রহীতা, সুদের চুক্তিপত্রের লেখক ও সাক্ষী সবার ওপর অভিসম্পাত করেছেন এবং বলেছেন, এরা সকলে সমান (অপরাধী) অধিকারী।’ –সহিহ বোখারি
ইসলাম সুদকে নিষিদ্ধ করেছে ঠিক, কিন্তু এর বিকল্প ব্যবস্থার বিধানও দিয়েছে। পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন স্থানে সুদমুক্ত হালাল উপার্জনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে আল্লাহতায়ালা সব ধরনের অবৈধ উপায়ে উপার্জনের পথ পরিহারের নির্দেশ দিয়েছেন।
হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার হজরত বেলাল (রা.) নবী করিম (সা.)-এর কাছে ‘বর্নি’ (এক ধরনের) খুরমা নিয়ে এলেন। নবী করিম (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, এ ধরনের খুরমা তুমি কোথা থেকে পেলে? তিনি বললেন, আমার কাছে দুই সা (প্রায় আট কেজি) মন্দ খেজুর ছিল, আমি তা এই এক সা (প্রায় চার কেজি) খেজুরের বিনিময়ে বিক্রি করেছি। এটা শুনে রাসূলে কারিম (সা.) (একাধিকবার) বললেন, আহ! এতে সুদি লেনদেন হয়েছে। আহ! এতে সুদি লেনদেন হয়েছে, এমন লেনদেন আর করো না। অধিক মন্দ খেজুর টাকার বিনিময়ে বিক্রি করবে, তারপর সে টাকায় উত্তম খেজুর ক্রয় করবে। -সহিহ বোখারি ও মুসলিম
এখানে নবী করিম (সা.) সুদি লেনদেনকে চিহ্নিত করে হালাল লেনদেনে রূপান্তরের পদ্ধতি সুস্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন।
ইসলামের ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কে কোরআনে কারিমের পর হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। এসব হাদিসে বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যের নানাদিক। নবুওয়তের আগে ও পরে নবী করিম (সা.) নিজ জীবনের কর্মকাণ্ড দিয়ে দেখিয়েছেন কিভাবে লেনদেন করতে হবে, কিভাবে পণ্য বিনিময় করতে হবে, কিভাবে বান্দার হক যথাযথভাবে আদায় করতে হবে।
মদিনা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নবী করিম (সা.) ব্যবসা-বাণিজ্যের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ সারা বিশ্বের মানুষের জন্য স্থাপন করে গেছেন। তা আজও আমাদের সবার জন্য শিক্ষণীয়ও অনুকরণীয়।
ধন-সম্পদ সঞ্চিত করে রাখা এবং অধিক জনকল্যাণের কাজে এটা নিয়োগ না করা ইসলামি অর্থনীতির দৃষ্টিতে মারাত্মক অপরাধ। ইসলামি সমাজের অর্থসম্পদ কোনোক্রমেই এক হাতে বা একটি গোষ্ঠীর মুষ্টিতে পুঞ্জীভূত হতে ও অব্যবস্থায় পড়ে থাকতে পারে না। এমন কি, কোনো এতিম শিশুরও কোনো নগদ অর্থ থাকলে তাও যেকোনো লাভজনক কাজে বিনিয়োগ করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘সাবধান, তোমাদের কেউ এতিমের সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণকারী নিযুক্ত হলে এবং তাদের নগদ অর্থ থাকলে তা অবশ্যই ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করবে। তা অকাজে ফেলে রাখবে না। বাৎসরিক জাকাত অকাজে ফেলে রাখবে না। অন্যথায় বাৎসরিক জাকাত ও সদকা মূলধন নিঃশেষ করে ফেলবে।’
পবিত্র কোরআনে এ সম্পর্কে চূড়ান্তভাবে ঘোষণা করা হয়েছে, ‘ইসলামি সমাজের ধন-সম্পদ যেন কেবল ধনীদের মধ্যেই কুক্ষিগত ও পুঞ্জীভূত হয়ে থাকতে না পারে।’