ইসলামের অলৌকিকতা হলো, কোরআনে কারিমের বাণী সর্বকালের সব সময়ের জন্য আধুনিক, প্রাত্যহিক এবং প্রাসঙ্গিক। এই প্রাসঙ্গিকতাকে ব্যাখ্যা করে গেছেন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার আচার-আচরণ দ্বারা, জীবন-যাপন, কর্ম ব্যবস্থাপনা এবং সুচিন্তিত ও পরিশীলিত নির্দেশ দ্বারা। তাই তার জীবন নিয়ে পৃথিবীতে আলোচনা হয়েছে, এখনও আলোচনা হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। তার জীবন কথা নিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে, নানারূপ তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা হযেছে, ঐতিহাসিক সত্য নির্ধারণের চেষ্টা হয়েছে, বিশ্লেষণ হয়েছে এবং অভিভূত মানুষের বিনয়ের প্রকাশ ঘটেছে। এ ধারা কখনও শেষ হবে না, চলতে থাকবে যতদিন বিশ্ব থাকবে।
যে জীবন মানুষকে অভিভূত করে, যে জীবন আল্লাহতায়ালার নিকট আত্মসমর্পণের একটি অলৌকিক পরিচয় বহন করে এবং যে জীবন সব মানবের কল্যাণে সর্বসময়ের জন্য নিয়োজিত, সেই জীবনের একটি মনোজ্ঞ আলেখ্য আমাদের নবী মুহাম্মদ (সা.)। আজকে নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর বিশাল জীবনের একটি ক্ষুদ্র বিষয়ে আলোকপাত করা হবে- ইনশাআল্লাহ। আর তা হলো, ব্যবসা-বাণিজ্যে নবী করিম (সা.)-এর অংশগ্রহণ ও উম্মতের জন্য রেখে যাওয়া আদর্শ।
নবুওয়তের আগে ও পরে রাসূলে কারিম (সা.)-এর ব্যবসায়িক কার্যক্রম কিরূপ ছিল, কিভাবে তিনি ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন, কী কী নিয়মকে ব্যবসার ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিয়েছেন, আল্লাহতায়ালা কোরআনে কারিমে ব্যবসা সম্পর্কে কী বলেছেন, রাসূলে কারিম (সা.) ব্যবসা নিয়ে কী কী গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রেখেছেন তা নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করা আজকের মূল বিষয়।
দাদা আবদুল মুত্তালিবের ধন-সম্পদের পরিমাণ জীবনের শেষের দিকে কমতে থাকে। মুত্তালিব মৃত্যুকালে যে সম্পদ রেখে গিয়েছিলেন, তার পরিমাণ খুব বেশি ছিল না। ছেলেদের মধ্যে সম্পদের বণ্টনের পর উল্লেখযোগ্য সম্পদ আবু তালিবের ভাগে ছিল না। তদুপরি বালক মুহাম্মদ (সা.)-এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পড়ে চাচা আবু তালিবের ওপর। তিনি পিতৃব্যের মেষ পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মক্কার নিকটবর্তী পাহাড়ের পাদদেশে মুহাম্মদ (সা.) ছাগল ও মেষ চড়াতেন। কখনও কখনও চাচা আবু তালেব তাকে নিয়ে দূর পথে যেতেন। যখন হজরতের বয়স মাত্র ৯ বছর তখন চাচা আবু তালেব তাকে নিয়ে ব্যবসার উদ্দেশ্যে সিরিয়া গমন করেন। এটাই রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনে প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। সিরিয়া ভ্রমণ রাসূল (সা.)-এর জীবনে অনেক বড় ঘটনা। বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান অর্জন এবং সৃষ্টি সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য তার হৃদয়ে স্থান করে নেয় এ সময়।
যৌবনে উপনীত হয়ে তিনি ব্যবসাকে জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। একজন ব্যবসায়ীর প্রধান গুণ হচ্ছে- প্রতিশ্রুতি পূরণ করা এবং প্রতিজ্ঞা রক্ষা করা। নবুওয়ত প্রাপ্তির আগে একজন সৎ ব্যবসায়ী হিসেবে নবী করিম (সা.) তার সমকালের সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত ছিলেন। ব্যবসার ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকে, আরব দেশেও ছিল। ব্যবসা ক্ষেত্রে তার সঙ্গে যাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল তারাও তার নানাবিধ সদগুণের প্রশংসা করেছেন। ব্যবসার ক্ষেত্রে অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিয়ে হজরত মুহাম্মদ (সা.) যখন সবার কাছে শ্রদ্ধাভাজন এবং প্রিয় হয়েছিলেন তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২০ বছর। আরব দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং জ্ঞান গরিমায় অনেক সময় রমণীরা পুরুষের সমান ছিলেন। এ রকম একজন রমণী ছিলেন বিবি খাদিজা (রা.)। সে সময় চতুর্দিকে সততা ও বিশ্বস্ততার জন্য মুহাম্মদ (সা.)-এর খুব সুনাম ছিল। তিনি ছিলেন ‘আল আমিন।’ বিবি খাদিজা সিরিয়ায় পণ্যসামগ্রী নিয়ে যাওয়ার জন্য মুহাম্মদ (সা.) কে নিযুক্ত করলেন। এভাবে রাসূলে করিম (সা.) নবুওয়তপ্রাপ্তির আগে ব্যবসা সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।
নবুওয়ত লাভের পর মুহাম্মদ (সা.) পুরোদমে ইসলাম প্রচারে নিজেকে নিয়োজিত করেন। ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্য তখন কতটুকু করেছেন তার বিবরণ আমাদের জানা নেই। তবে ইসলাম প্রচারের সর্বশক্তি নিয়োগের পর আল্লাহতায়ালার নির্দেশে মদিনা রাষ্ট্র কায়েমের মাধ্যমে ইসলামের প্রথম ছোট্ট মডেল উপহার হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে রাখলেন। পবিত্র কোরআনে ধীরে ধীরে ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে জীবনের সব বিষয় আল্লাহতায়ালা রাসূলে কারিম (সা.)-এর মাধ্যমে মানবজাতির জন্য শিক্ষণীয় করে প্রতিষ্ঠিত করলেন।
পবিত্র কোরআনে ব্যবসা সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা ক্রয়-বিক্রয়, ব্যবসা-বাণিজ্য হালাল করেছেন, কিন্তু সুদ ও সুদভিত্তিক যাবতীয় কারবার হারাম ঘোষণা করেছেন।’ -সূরা বাকারা
অর্থ উপার্জনের মধ্যে সবচেয়ে সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে- ব্যবসা-বাণিজ্য। অন্য সব উপায় অপেক্ষা ব্যবসা-বাণিজ্য শ্রেষ্ঠ। তাই পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ব্যবসাকে অনেক অনেক উৎসাহ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘নামাজ সমাপ্ত হওয়ার পর তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো, আল্লাহর অনুগ্রহ ধন-সম্পদ অনুসন্ধান, আহরণ ও উপার্জন করো।’
আল্লাহতায়ালা নামাজ কায়েম করতে বলেছেন এবং নামাজ শেষে নিজের উপার্জনের জন্য কাজে ব্যস্ত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। সম্পদ নিয়ে অনুসন্ধান, গবেষণা করতে বলেছেন। সম্পদ আহরণ করতে বলেছেন। সম্পদ উপার্জন করার তাগিদ দিয়েছেন। নামাজ পড়ে ঘরে বসে থাকতে বলেননি।
তাই সব নবী-রাসূল আল্লাহতায়ালার নির্দেশ অনুযায়ী উপার্জনের জন্য ব্যবসাকে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছেন। নবী মুহাম্মদ (সা.) নবুওয়তের আগে থেকে ব্যবসাকে জীবিকা উপার্জনের প্রধান মাধ্যম হিসেবে দায়িত্ব পালন করে উম্মদের জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। আল্লাহতায়ালার নির্দেশ নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করে মানবজাতির জন্য আদর্শ রেখে গেছেন। নবী করিম (সা.) মুসলমানদের ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য বিশেষ উৎসাহ দিয়েছেন এবং সত্যবাদী, বিশ্বস্ত ও ন্যায়পন্থী ব্যবসায়ীদের বিশেষ মর্যাদার কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘সত্যবাদী, ন্যায়পন্থী ও বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী আম্বিয়া (নবীর বহুবচন), সিদ্দিক ও শহীদ প্রভৃতি মহান ব্যক্তির সমান মর্যাদায় অভিষিক্ত হবেন।’
ইসলামে ব্যবসা-বাণিজ্যকে ‘অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ কাজ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থ উপার্জনের জন্য ব্যবসা অতি উত্তম ইবাদত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। একজন সত্যবাদী, ন্যায়পন্থী বিশ্বস্ত ও সৎ ব্যবসায়ীকে শহীদ, আম্বিয়ায়ে কেরাম এবং সিদ্দিকদের কাতারে শামিল করেছে। এর চেয়ে বেশি মর্যাদার আর কী হতে পারে? কিন্তু আমাদের সমাজে, মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ব্যবসায়ীদের কী নমুনা আমরা দেখতে পাচ্ছি? আমাদের নবী, অন্যান্য নবী ব্যবসার কী দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন, তা কি আমরা একবারও ভেবে দেখছি?
ব্যবসার সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করা। সততার সঙ্গে ব্যবসা করা। সময়, কাজ, ঠিকমতো করা। তাই আধুনিক ব্যবসায় আর্থিক সরাসরি লেনদেন ছাড়াও চুক্তিপত্রের মাধ্যমে তথা এলসির মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত হচ্ছে। নবীজীর সময় বা নবুওয়তের আগে এলসি না থাকলেও তাদের মুখের কথা ও জবানই ছিল এলসি থেকে উত্তম। একজন ব্যবসায়ীর প্রধান গুণ হচ্ছে প্রতিশ্রুতি পূরণ করা এবং প্রতিজ্ঞা রক্ষা করা। নবুওয়তপ্রাপ্তির আগে একজন সৎ ব্যবসায়ী হিসেবে মহানবী (সা.) তার সময়কালের এক সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত ছিলেন। তিনি অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে তার কর্তব্য সম্পাদন করতেন। মানুষ তার ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করতে পারত।
আবু দাউদে বর্ণিত এক হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উবাই আল হামসা রাসূল (সা.)-এর নবুওয়তপ্রাপ্তির আগে তার ব্যবসা সংক্রান্ত কিছু কাজ করছিলেন। দানের কিছু অংশ দেওয়া হয়েছিল এবং কিছু অংশ বাকি ছিল। ইবনে উবাই রাসূল (সা.) কে বললেন, ‘আপনি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন বাকি টাকা পরে নিয়ে আসছি। ঘটনাচক্রে ইবনে উবাই এ প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে যান। তিন দিনের দিন হঠাৎ সব ঘটনা তার মনে পড়ল এবং তিনি বাকি টাকা নিয়ে প্রতিশ্রুত স্থানে উপস্থিত হয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) কে সেখানে দেখতে পেলেন। ইবনে উবাই রাসূলের (সা.) মধ্যে কোনো বিরক্তির ভাব দেখলেন না। তিনি শুধু বললেন, ‘তুমি আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছ, আজ তিন দিন যাবত আমি এখানে তোমার অপেক্ষায় বসে আছি। দেখুন, কেমন নমুনা নবী করিম (সা.) আমাদের জন্য ব্যবসার ক্ষেত্রে স্থাপন করে অনুকরণের জন্য রেখে গেছেন। আমরা কি তা পালন করছি? আমরা কি নবীর ব্যবসার শিক্ষা থেকে জীবনে শিক্ষা গ্রহণ করছি? কেউ কেউ, কিছু কিছু করছি। কিন্তু সব ব্যবসায়ী তা করছি না। এটি অন্যায়। এই অভ্যাস আমাদের আগে করতে হবে। কোরআন ও হাদিসের আলোকে ব্যবসায়ী হিসেবে নাজাত পেতে হলে উল্লিখিত চরিত্রের অধিকারী হতে হবে, তবেই মুক্তি মিলবে।