মানুষ আল্লাহতায়ালার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। মানুষকে মহান আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন অনেক ভালোবেসে। শুধু সৃষ্টিই করেননি, করেছেন সবার মাঝে সম্মানিত। পবিত্র কোরআনে এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আমি বনি আদমকে করেছি সম্মানিত।’ -সূরা ইসরা: ১৭
পৃথিবীতেই মানুষের বসবাস। কত আকার, প্রকৃতি, চিন্তা ও মানসিকতার মানুষ রয়েছে এর হিসাব কেউ জানে না। সাদা-কালো, লম্বা-খাটো, ধনি-গরিব, নানা ধর্ম, শত মত ইত্যাদি ছাপিয়ে সবার এক পরিচয়- মানুষ। যে মানুষ হয় উপকারী, অন্যের কষ্টের ভাগীদার, সত্যের ধারক, পরোপকারী ও নির্লোভ। যার দ্বারা কোনো মানুষ তো দূরের কথা, নিরীহ পশু-পাখি কিংবা জীব-জন্তুরও ক্ষতি হয় না।
চারদিকে এখন চলছে- মিথ্যা, জুলুম, অবিচার-অনাচার, স্বার্থবাদিতা, পদ-পদবীর লড়াই, সম্পদ জবর-দখলের লড়াই, খুন-খারাবি, চুরি, হত্যা, ধর্ষণ, ব্যভিচার, লুন্ঠন, মাদকাসক্তির সয়লাব। সমাজের বিশাল এক শ্রেণির লোক এসব অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত। আর অন্যরা কালোশক্তির ভয়ে নির্লিপ্ত, নির্বিকার। জালিমের ভয়ে নিশ্চুপ, অসহায়।
মৃতপ্রায় রোগীকে নিয়ে দু’জন চিকিৎসালয়ের সামনে দাঁড়ানো। একজন দৌঁড়ে এলেন। বিপদের সময় মনে হলো, তিনি কত আপন। পরামর্শ দিলেন নির্দিষ্ট ক্লিনিকে নেওয়ার। রোগীকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে কমিশনের ৫শ’ টাকার নোটখানা পকেটে পুরে স্বস্তির ঢেঁকুর তুলে সালাম দিয়ে চলে গেলেন উপকারী বন্ধু। তিনিও কিন্তু মানুষ!
এখানেই কি শেষ? সাত হাজার টাকার টেস্ট করে ডাক্তার সাহেব বললেন, তেমন কিছু হয়নি, ওষুধ খান সব ঠিক হয়ে যাবে। চলতে থাকে রোগী আর চিকিৎসকের দেখা-সাক্ষাত কিন্তু রোগ সারে না। পরে অন্য ডাক্তারের কাছে জানা যায়, এতদিন তার চিকিৎসা হয়েছে ভুল। ওরাও নাকি মানুষ!
এই মানুষদের মাঝেই কেউ সনদ জাল করে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অফিসার, শিক্ষক হন। খোঁজ মেলে ভুয়া ডাক্তারের। এই মানুষেরাই রডের পরিবর্তে বাঁশ দিয়ে ভবন বানান। খাবারে ভেজাল মেশান, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি করেন। আইনের লোক হয়ে বেআইনি নানা কাজ করেন। শিক্ষক হয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস করেন। ভাবলে মনে হয়, সত্যিই এ সমাজে মানুষ আছে তো?
এই সমাজে ধর্ষিতারা পালিয়ে বেড়ায়। সম্মান বাঁচাতে আত্মহত্যা করে। অনেকে দিনের পর দিন নীরবে সয়ে চলে নানা অত্যাচার। আর ধর্ষকরা সমাজ দাপিয়ে বেড়ায়। ক্ষুধার জ্বালায় অস্থির কিশোর চোরকে পিটিয়ে মেরে উল্লাস করা সহজ, কিন্তু দুর্নীতিবাজদের দমানো কঠিন। এরাও কিন্তু এই সমাজের মানুষ। তাদের কারও পরিচয় রাজনীতিবিদ, সমাজসেবী, গরিবের বন্ধু! সত্যিকারার্থেই কি তারা মানুষ?
রাজনৈতিক পরিচয়ে যে দেশে ট্রাফিক আইন চলে, বিশেষ কিছুর বিনিময়ে অফিসের ফাইল চলে, ফোনের জোরে হাসপাতালের চিকিৎসা মেলে, চাকরিতে ঘুষ লাগে, ব্যাংক ঋণ পেতে কমিশন লাগে, এতিমদের রক্ষক হয় ভক্ষক, মসজিদ কমিটির নেতা হওয়ার জন্য ভোট হয়- সে দেশে আর যাই হোক সত্যিকারের মানুষের সংখ্যা বেশি নেই। তাহলে বলবেন, ওরা কারা- যাদের ভিড়ে চলা যায় না, বলি ওরা অমানুষ। দেখতে একেবারেই মানুষের মতো!
অবৈধ সম্পদের পাহাড়, ক্ষমতার দাপট, প্রভাব বিস্তারের মহড়া, মাদকের ছড়াছড়ি দেখতে দেখতে সাধারণ মানুষ হতাশ। এসবের পেছনে যারা আছেন, তারাই আবার সমাজের নেতৃস্থানীয়। তারাও কিন্তু মানুষ? আমার-আপনার মতো মানুষ।
কবি বলছেন, ‘যদি আকার-আকৃতিতে মানুষ হতো, তবে আবু জেহেল আর মুহাম্মদ দু’জনই মানুষ হতো।’ আর আল্লাহতায়ালা বলছেন, ‘আর আমি সৃষ্টি করেছি দোজখের জন্য বহু জ্বিন ও মানুষ। তাদের অন্তর রয়েছে, তা দ্বারা বিবেচনা করে না, তাদের চোখ রয়েছে, তারা তা দ্বারা দেখে না, আর তাদের কান রয়েছে, তা দ্বারা শোনে না। তারা চতুষ্পদ জন্তুর মতো; বরং তাদের চেয়েও নিকৃষ্টতর। তারাই হলো- গাফেল, শৈথিল্যপরায়ণ।’ -সূরা আল আরাফ: ১৭৯
ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার আরাম-আয়েশের জন্য আপনি অন্যায়-অপকর্ম করছেন, কিন্তু বুকে হাত দিয়ে বলনু তো, মনে শান্তি আছে? ধরে নিলাম, খুব আরাম-আয়েশে জীবন কাটাচ্ছেন, কিন্তু আখেরাতে আল্লাহর কাজে কী জবাব দেবেন? তাই বলি, অমানুষ হিসেবে নয়, যতদিন দুনিয়ায় বাঁচবেন- মানুষ হিসেবে বাঁচার চেষ্টা করুন। তাতে দুনিয়ায় যেমন শান্তি পাবেন, পরকালেও পাবেন আল্লাহর সন্তুষ্টি ও চির সুখের স্থান বেহেশত।
মুহাম্মদ হাসান মুরাদ: শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম বুজরুকগড়গড়ী, চুয়াডাঙ্গা।