মক্কা মোকাররমা (সৌদি আরব) থেকে: পবিত্র নগরী মক্কা মোকাররমায় আজ তিনি সফল ব্যবসায়ী। প্রবাসীদের কাছে আইকন। বৈদ্যুতিক মিস্ত্রীর জোগালি থেকে আজ আমি এখানে- বেশ গর্বের সঙ্গেই নিজের অতীত নিয়ে গর্ব করেন তিনি।
প্রবাসীদের কাছে নিজের জীবন সংগ্রামের এই গল্প বলে তাদের পাশে থেকে জুগিয়ে যান প্রেরণা।
তিনি মো. কামাল উদ্দিন (৫৮)। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি থানার দুরং গ্রামের নবীর হোসেনের ছেলে। চার ভাই দুই বোনের মধ্যে সবার বড়।
চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষার্থী। অভাব-অনটনের সঙ্গে নিত্য যুদ্ধ। পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতা ফেরাতে অনার্স পরীক্ষা না দিয়েই ১৯৮১ সালে পাড়ি দেন মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশ সৌদি আরবে।
তখন নিয়ম-কানুন এত কঠিন ছিলো না। এক আদম ব্যবসায়ী মাত্র একটা ছবি নিয়ে গলাকাটা পাসপোর্টে আলী আহমেদ নামে আমাকে পাঠালেন এদেশে। শর্ত হলো- এ দেশে কাজ করে তার টাকা শোধ করে দেবো।
হজ ভিসায় মক্কায় এলাম। তখনো চেহারা থেকে কলেজ ছাত্রের আবেশটা যায়নি। সমস্যা হলো- আমাকে কেউ কাজে নিচ্ছেন না।
মেসফালায় যে মেসে আমার ঠাঁই হলো, সেখানকার বাসিন্দাদের চিঠি লিখে দিতাম। এক মামার সূত্রে হয়ে গেলাম সকলের ভাগ্নে।
পরে মেসফালায় ইসমাঈল নামে এক এসি মেরামতকারীর কাছে কাজ শেখা শুরু করলাম। হাতুড়ি দিয়ে দেয়াল কাটা অর্থাৎ কনসেল ওয়্যারিং'র কাজ করলাম দু’মাস। হাতখরচ চাইতেই সাফ জবাব, কাজ শিখলে কি আবার টাকা দিতে হয়?
মনের দুঃখে গিয়ে দাঁড়ালাম এখানকার- শ্রমিক বাজারে। যেখানে কাজের সন্ধানে মানুষ জড়ো হন। চাহিদামতো কর্মীকে দিনচুক্তিতে কাজে নেওয়ার জন্য এলেন এক মিসরি।
বুকপকেটে টেস্টার দেখে এগিয়ে এলেন আমার সামনে। আমিসহ আরেকজন লেবারকে নিলেন। আমার দৈনিক হাজিরা ৫০ রিয়াল। এখানে মাস তিনেক কাজ করে ইলেকট্রিক্যাল কাজের পাশাপাশি, তালা-চাবির কাজ ও টেলিভিশন মেরামতসহ নানা ব্যতিক্রমী কাজ শিখে ফেললাম।
দেড় বছরের মাথায় আমার দৈনিক বেতন হলো- ১২০ রিয়েল। ততদিনে প্রায় ৫ হাজার রিয়াল জমিয়েছি।
দেশে ফিরলাম। এবার সরাসরি লেবার ভিসায় নিজনামে কাগজপত্র বানিয়ে এলাম সৌদি আরবে। সময়টা ১৯৮৩ সাল। ততদিনে আমি পুরোদস্তুর মিস্ত্রী।
১৯৮৭ সালে একটি রুমে উঠলাম। সেই রুমের আশেপাশে রুমগুলো তখন ফাঁকা। মালিককে বললাম, আমি ফাঁকা রুমগুলো ভাড়া নিতে চাই। এর মাঝে মিস্ত্রীর কাজ ছেড়ে পাশের একটি হোটেলের রিসেপশনে ১৫শ' রিয়াল বেতনে কাজ নিলাম। এখানে বখশিশ মিলতো। সেই সঙ্গে বেতন আর রুমভাড়া মিলিয়ে আয়টা বেশ হতো।
এভাবে রমজান মাস থেকে হজের মৌসুমে হোটেল চুক্তি নিয়ে ভাড়া দিলাম। ১৯৮৭ সালে দেশে গিয়ে বাবার পছন্দে বিয়ে করলাম নাদিরা আক্তার রুবিকে। ততদিনে হোটেল ব্যবসাটা রপ্ত করে ফেলেছি। আমরা যেখানে থাকতাম, সেই ভবনে এসে উঠলেন- নোয়াখালীর নুর মোহাম্মদ ভূইঁয়া।
১৯৯০ সাল। ইরাক আক্রমণ করে বসলো কুয়েতে। মধ্যপ্রাচ্যে টালমাটাল অবস্থা। এর মধ্যে প্রতিবেশী নুর মোহাম্মদ ভূইঁয়াসহ তিনজন মিলে শুরু করলাম আবাসিক হোটেল ব্যবসা। প্রথম পর্বে জনপ্রতি ৭ হাজার রিয়াল লাভ। তারপর থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বর্তমানে মক্কায় মসজিদুল হারামের পাশে হিলটনের হোটেলের পেছনে প্রাইম লোকেশনে বুরুজ আল সুলতান, আরিজ আল ফালাহ, নোয়ারাত আল সামস, রাওয়াবি শামেক নামের চারটি হোটেল পরিচালনা করছি। যেখানে আমরা ১ হাজার ৫৪৩ জনকে একসঙ্গে সার্ভিস দেই।
আমাদের কথা একটাই, এখানে যারা আসেন- সবাই আল্লাহর মেহমান। তাদের সন্তুষ্টিই আমাদের প্রেরণা। সব কর্মীকে বলা আছে, কোনো মেহমান যাতে মনে কষ্ট না পায়। আর সেটা ধরে রেখেছি বলেই, আল্লাহতায়ালা ইজ্জত ও সন্মানের সঙ্গে আমাদের টিকিয়ে রেখেছেন।
এইটুকু বলে বিরতি নেন কামাল উদ্দিন।
সততা, পরিশ্রম আর একগ্রতা থাকলে জীবনে সাফল্য যে সোনার হরিণ নয়, সেটা প্রমাণ করেছেন কামাল উদ্দিন। বিনয় আর ভালোবাসাটাই যেন তার মূলধন।
দেশেও মানুষের কল্যাণে গড়ে তুলেছেন মাতৃ ও শিশু কল্যাণ সংস্থা নামের ফাউন্ডেশন। যেখানে বিনামূল্যে প্রসূতি নারী ও শিশুদের দেওয়া হয় স্বাস্থ্যসেবা।
এছাড়া আধুনিক চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে চট্টগ্রামে অংশীদারদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন ন্যাশনাল হসপিটাল ও পার্কভিউ হসপিটাল নামের দু’টি হাসপাতাল।
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিজেকে বিলিয়ে দিতে চাই। সেবা দিয়ে মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে চাই- বলেন মক্বায় হোটেল ব্যবসার অগ্রপথিক কামাল উদ্দিন।