যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল কার্যালয় ও জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়মিত যাতায়াতকারী চেনামুখী অতিথিদের নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে।
শনিবার (১২ নভেম্বর) সন্ধ্যায় প্রবাসী গণমাধ্যমকর্মী ও সামাজিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ওয়াশিংটনস্থ বাংলাদেশের নতুন রাষ্ট্রদূত মুহাম্মদ ইমরানের মতবিনিময় সভায় দলীয় নেতাকর্মীসহ চিরাচরিত চেনামুখী তথাকথিত অতিথিদের উপস্থিতি দেখে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশিদের মাঝে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশ যখন ভয়াবহ আর্থিক সংকটের দ্বারপ্রান্তে। ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে আসছে ডলারের রিজার্ভ। রাষ্ট্রীয় ব্যয় সংকোচনের আহবানসহ দুর্ভিক্ষের আগাম বার্তা দিচ্ছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। সেই সময়ে বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল কার্যালয়ে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে মতবিনিময় সভার নামে পৃথক পৃথকভাবে নৈশ্যভোজ (ভুড়িভোজ)-এর ব্যবস্থা করা হয়। এতে অংশ নেন সামাজিক কথিত নেতৃবৃন্দ ও প্রবাসী গণমাধ্যমকর্মীরা। শুধু নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল কার্যালয়েই নয়, এমন দৃশ্য দেখা যায় জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের নানা অনুষ্ঠানাদিতেও। এ নিয়ে নিউইয়র্কের সর্বত্রই চলছে আলোচনার ঝড়।
শনিবার নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল কার্যালয়ে মতবিনিময় সভায় রাষ্ট্রদূত মুহাম্মদ ইমরান সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নে সরকার ও দূতাবাসের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণসহ প্রবাসীদের সর্বোচ্চ সেবা প্রদানের আশ্বাস দিয়ে বলেন, তার দূতাবাসের দরজা সকল প্রবাসীর জন্য খোলা। পাশাপাশি দেশের ভাবমর্যাদা বিদেশীদের কাছে তুলে ধরার জন্য তিনি দলমত নির্বিশেষে প্রবাসীদের সার্বিক সহযোগিতা কামনা করেন।
তিনি বলেন, একাত্তরের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশ এক নয়। স্বাধীনতার পঞ্চশ বছরে দেশে অনেক উন্নয়ন-অগ্রগতি হয়েছে। এই উন্নয়ন-অগ্রগতির কথা বিদেশিদের কাছে তুলে ধরার পাশাপাশি দেশের ভাবমর্যাদা তুলে ধরতে হবে। এজন্য সকল প্রবাসীকে দলমতের ঊর্ধ্বে সকলকেই একজন রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করতে হবে।
গত সেপ্টেম্বরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত হওয়ার পর সাংবাদিক ও কমিউনিটির বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে এটাই প্রথম মতবিনিময়। এর আগে রাষ্ট্রদূত বিভিন্ন মানি ট্রান্সফার প্রতিষ্ঠানের সিইও এবং প্রেসিডেন্টদের সঙ্গে কনস্যুলেটে মতবিনিময় করেন। এ সময় তিনি বৈধপথে প্রবাসীদের দেশে বেশি বেশি অর্থ প্রেরণের উপর গুরুত্বারোপ করেন এবং কনস্যুলেট বা দূতাবাসের করণীয় সম্পর্কে মতামত গ্রহণ করেন।
নিউইয়র্কে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল ড. মনিরুল ইসলামের সঞ্চালনায় মতবিনিময় সভায় ওয়াশিংটনে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের মিনিস্টার (প্রেস) এ জেড এম সাজ্জাদ হোসাইন, জাতিসংঘের বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনে নিযুক্ত মিনিস্টার (প্রেস) নূর-এ ইলাহী মিনা ও সোনালী এক্সচেঞ্জ ইনক’র প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা দেবশ্রী মিত্র উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে, গত কয়েক বছর যাবত নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল কার্যালয়ে প্রতিমাসেই নানা ধরনের অনুষ্ঠান হচ্ছে। এতে থাকছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও নৈশ্যভোজের ব্যবস্থা। এসব অনুষ্ঠানে বরাবরই দলীয় নেতাকর্মীসহ চিরাচরিত চেনামুখী তথাকথিত অতিথিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। ঘুরে ফিরে প্রতিটি অনুষ্ঠানেই তাদের চেহারাই দেখা যায়। নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেলের আওতাধীন ৮টি অঙ্গরাজ্য থাকলেও বাকি ৮টি অঙ্গরাজ্যের কোন অতিথিকেই কোন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয় না।
শুধু তাই নয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের বেলায়ও একই ধরনের কর্মকাণ্ড চলে আসছে। নিউ জার্সি, ম্যাসাচুসেটস, নিউ হ্যাম্পশয়ার, মেইন, কানেকটিকাট, রোড আইল্যান্ড ও ভারমন্টের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রতিভাবান শিল্পী ও কলা কুশলীদের কখনই আমন্ত্রণ জানানো হয় না। শুধুমাত্র নিউ ইয়র্কের দু'টি সাংস্কৃতিক সংগঠন বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব পারফর্মিং আর্টস (বিপা) ও বাংলাদেশ একাডেমি অব ফাইন আর্টস (বাফা) দিয়েই দায়সারা গোছের অনুষ্ঠান করা হয়। প্রবাসীদের ধারনা যে এ দু'টি সংস্থার সাথে নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেলের শত বছরের চুক্তি সম্পাদন হয়েছে।
বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল কার্যালয় ও জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের খাতায় কবে অতিথিদের তালিকায় লিপিবদ্ধ হয়েছে তা জানা যায়নি। তবে তালিকায় রয়েছে তথাকথিত গণমাধ্যমকর্মী, তথাকথিত কমিউনিটি ও দলীয় নেতাকর্মী, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা এবং প্রবাসী ভবঘুরে ব্যক্তিবর্গ। এসব লোকদেরকে কনস্যুলেট ও বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের অনুষ্ঠানে দেখলে অনেকেই হাসাহাসি করেন। তবে অতিথিদের তালিকা সংশোধনের জন্য অনেকবার মিডিয়াকর্মীরা তাদেরকে তাগিদ হয়েছিলো কোন কাজ হয়নি।
নিউইয়র্কের জনৈক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, নিউইয়র্কে লাখ লাখ বাংলাদেশির বসবাস। এদের মধ্যে রয়েছে ব্যবসায়ী, বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এবং বিভিন্ন পেশার বিপুল সংখ্যক মানুষ, যারা নিয়মিত মোটা অংকের অর্থ দেশে প্রেরণ করে থাকেন। এমন ব্যক্তিদের কখনই বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল কার্যালয় ও জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয় না। যারা কালেভদ্রে দেশ টাকা পাঠান তাদেরকেই বারবার কেন কনস্যুলেট জেনারেলে ও জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনে আমন্ত্রণ জানিয়ে দাওয়াত খাওয়াতে হবে তা নিয়েও প্রবাসীদের মাঝে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন? মধ্যাহ্নভোজ কিংবা নৈশ্যভোজ ব্যতিরেকে বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল কার্যালয় ও জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের সকল প্রকার অনুষ্ঠানে প্রবাসীদের জন্য দ্বার উন্মুক্ত থাকা বাঞ্ছনীয় বলে মনে করেন সচেতন প্রবাসীরা।
তাদের মতে অর্থ ব্যয় করে বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল কার্যালয় ও জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনে গুটিকয়েক চিরাচরিত চেনামুখী তথাকথিত অতিথিদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা না করে বড় পরিসরে জাতীয় অনুষ্ঠানগুলোর আয়োজন করলে প্রবাসীরা বেশি আনন্দ পেতো।
উল্লেখ্য বিহির্বিশ্বে বাংলাদেশ কনসুলেটগুলোর মধ্যে জেদ্দার পরেই নিউ ইয়র্কের স্থান। পাসপোর্ট, ভিসাসহ যাবতীয় কনস্যুলেট সেবার কাজে বড় ধরণের আয় করে থাকেন নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল। রাষ্ট্রীয় এ তহবিলের অর্থ তথাকথিত গণ্যমান্য ব্যক্তিদের জন্য নয়। এতে সকল প্রবাসীদের সমান অধিকার রয়েছে। এছাড়াও অপ্রয়োজনীয় অনুষ্ঠানাদির ওসিলায় মোটা অঙ্কের অর্থের অপচয়ের বিষয়টিও এসেছে প্রবাসীদের নানা আলোচনায়।