দেশে প্রতিটি পরিবারে অন্তত একজন হাঁটু ব্যথায় ভুগছেন। নটরডেম কলেজবন্ধু ফোন করে জানাল তার আশি বছর বয়সী বাবার হঠাৎ হাঁটুতে প্রচণ্ড ব্যথা। ব্যথার তীব্রতা এতই বেশি যে, হাঁটুতে ভর করে দাঁড়ানো বা হাঁটা সম্ভব হচ্ছিল না। ফলে তার প্রাত্যহিক কাজকর্ম যেমন গোসল করা, ওজু করা, ওঠাবসা করে নামাজ পড়া, বাথরুমে যাওয়া, বাসার ভেতর হাঁটা প্রায় বন্ধ। তার এই সমস্যা পরিবারের সবাইকে চিন্তিত করে তুলল।
বন্ধুর বাবার বিস্তারিত সব শুনে ও জেনে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও চিকিৎসা বলে দিলাম। আমাদের প্রতিটি পরিবারে মা-বাবা, দাদা-দাদী, নানা-নানীসহ বয়স্কদের বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে শারীরিক সক্ষমতা লোপ, পেশী ও হাড়ের দুর্বলতার কারণে তাদের কেউ না কেউ হাঁটুর ব্যথায় ভুগছেন। তারাসহ অন্য বয়সের আরও অনেকেই হাঁটুর ব্যথায় ভুগছেন।
হাঁটু ব্যথার কারণ যাই হোক না, ব্যথার কারণে পায়ে ভর দিয়ে যেকোন কাজ বিঘ্নিত হওয়া থেকে শুরু করে ওঠা-বসা, দাঁড়ানো, হাঁটা, হাঁটু ভাজ করাসহ এরকম সব কাজ কষ্টকর হয়। অনেক সময় হাঁটু গরম, ফোলা বা কটকট শব্দও হয়।
হাড়ের ক্ষয় বা অস্টিও আর্থ্রাইটিস হাঁটু ব্যথার প্রধান কারণ হলেও হাঁটুর মেনিসকাস, লিগামেন্ট, বার্সা ইনজুরি, স্থূলতা, বিভিন্ন ভিটামিন ও মিনারেলস, হাড় ও মাংস পেশীর দুর্বলতা অনেকাংশে হাঁটু ব্যথার জন্য দায়ী।
করণীয়: কারণ নির্ণয়পূর্বক চিকিৎসা
রোগীর সাব্জেক্টিভ, অব্জেক্টিভ/ক্লিনিক্যাল এক্সামিনেশন এবং প্রয়োজনে বিভিন্ন ইনভেস্টিগেশনের মাধ্যমে হাঁটু ব্যথার কারণ নির্ণয়পূর্বক ফিজিওথেরাপিসহ অন্যান্য চিকিৎসা প্রয়োজন হয়। এ ক্ষেত্রে ফিজিওথেরাপি কার্যকরী প্রধান চিকিৎসা পদ্ধতি।
হাঁটু ব্যথায় ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকের গুরুত্ব
প্রথমত হাঁটু ব্যথা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মেকানিক্যাল কারণে হয়ে থাকে। সমস্যা যেহেতু মেকানিক্যাল, তার সমাধানও মেকানিক্যালি সম্ভব। ফিজিওথেরাপিকে বলা হয় মেকানিজম বেইজড প্রমাণিত চিকিৎসা, যার মাধ্যমে রোগের উৎস বা কারণকে চিকিৎসা প্রদান করে রোগীকে সুস্থ করা হয়।
হাঁটু হচ্ছে মানবদেহের অন্যতম ওজন বহনকারী জটিল জয়েন্ট—তাই দৈনন্দিন চলাফেরার জন্য শক্তিশালী হাঁটুর দরকার হয়। ব্যথার কারণে হাঁটু দুর্বল হতে থাকে এবং এই দুর্বলতার প্রধান কারণ মাংস পেশী ও হাড়ের দুর্বলতা। মাংস পেশী ও হাড়কে শক্তিশালী করতে ফিজিওথেরাপির বিকল্প নাই।
ফিজিওথেরাপি একদিকে হাঁটুকে শক্তিশালী করছে অন্যদিকে হাঁটুর ব্যথা সারানো, হাঁটুর মোবিলিটি ফিরিয়ে আনাসহ স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরিয়ে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। হাঁটুকে ভালো করতে বা ভালো রাখতে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকের পরামর্শপত্র ও সঠিক নির্দেশনা (লাইফস্টাইল রুটিন) এবং কার্যকরী ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা পদ্ধতিসমূহ, যেমন—এক্সারসাইজ প্রেস্ক্রিপশন মেনে সুনির্দিষ্ট এক্সারসাইজ, কিছু ইলেক্ট্রথেরাপিসহ অন্যান্য পদ্ধতির যথাযথ প্রয়োগ গুরুত্বপূর্ণ।
ফিজিওথেরাপির পাশাপাশি রোগীর শারীরিক অবস্থা বিবেচনা এবং ব্যথার মাত্রা ও কারণ অনুযায়ী স্বল্পকালীন কিছু ব্যথানাশক বা প্যারাসিটামল ওষুধ, সাপ্লিমেন্ট, যেমন— ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ‘ডি’সহ বিভিন্ন রিজেনারেটিভ মেডিসিন খাওয়া যেতে পারে।
হাঁটু ব্যথায় সার্জারি থেকে দূরে থাকতে চাইলে ব্যথার শুরুতেই ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। এ ক্ষেত্রে দেরি করলে হাড়ের ক্ষয়, পেশির দুর্বলতা, জোড়ার প্রদাহ ও শারীরিক অক্ষমতা বাড়তে থাকে। আর শুরুতে আসলে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকেরা খুব সহজে ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে শক্তিশালী হাঁটু গঠনের মাধ্যমে অতি অল্প সময়ে রোগীকে ব্যথামুক্ত কর্মক্ষম জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারেন।
করোনা পরিস্থিতিতে বাড়িতে হাঁটুর ব্যথায় যা করবেন
=> পরিচিত ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকের কাছে ফোনে আলোচনা করে পরামর্শ নিন।
=> হাঁটুকে পূর্ণ বিশ্রাম দিতে পারেন।
=> যেসব কারণে ব্যথা বাড়ে (যেমন হাঁটু ভাজ করা, নিচে বসা, সিঁড়িতে ওঠা নামা করা, লো কমডে বসা, দাঁড়িয়ে থাকা, হাঁটা ইত্যাদি) সেগুলো এড়িয়ে চলুন। আর যেভাবে হাঁটু রাখলে ব্যথা কম লাগে, সেভাবে রাখার চেষ্টা করুন।
=> ব্যথার স্থানে ব্যথার ধরন ও কারণ অনুযায়ী ব্যথার ক্রিম লাগিয়ে সুতার তোয়ালে দিয়ে ২০ মিনিট গরম সেঁক ও ১০ মিনিট ঠাণ্ডা পানির সেঁক দিনে ৩ থেকে ৪ বার দিতে পারেন। অথবা প্রয়োজনে শুধু গরম বা ঠাণ্ডা পানির সেঁক দিতে পারেন।
=> হাঁটা বা চলাফেরার সময় নি-ক্যাপ বা প্রয়োজনে স্টিকও ব্যবহার করতে পারেন।
=> পুষ্টিকর ও অ্যান্টিটক্সিক খাবার খাওয়ার অভ্যাস করুন এবং শরীরের সঠিক ওজন বজায় রাখুন।
=> এক্সারসাইজ করতে চাইলে অবশ্যই এক্সারসাইজ প্রেসক্রিপশন মেনে করুণ, না হয় ভুল এক্সারসাইজে আপনার ব্যথা বেড়ে যেতে পারে।
ডা. দলিলুর রহমান, সিনিয়র কনসালটেন্ট, কেয়ার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল; পেইন, ফিজিওথেরাপি ও স্পোর্টস ইঞ্জুরি বিশেষজ্ঞ।