আগামীকাল সঙ্গীত ক্যারিয়ারে বর্ণাঢ্য ছয় দশক (৬০ বছর) পার করবেন উপমহাদেশের অন্যতম সেরা শিল্পী রুনা লায়লা। বাংলা গানের ভাণ্ডার তার অসম্ভব সমৃদ্ধ। হিন্দি ও উর্দু ভাষায়ও রয়েছে তার কালজয়ী একাধিক গান। মোট ১৮টি ভাষায় ১০ হাজারের বেশি গান করেছেন। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ‘স্বাধীনতা পদক’-এ তিনি ভূষিত হয়েছেন অনেক বছর আগে। চলচ্চিত্রে গান পেয়ে পেয়েছেন ৮ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। জীবন্ত কিংবদন্তী এই গায়িকা জীবনের এমন শুভলগ্নে কথা বলেছেন বার্তা২৪.কমের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাসিদ রণ
ছয় দশক, বিরাট ব্যাপার। আপনি সমান ব্যস্ততার সঙ্গে গানের ক্যারিয়ারে ৬০টি বছর পার করলেন। বিষয়টি ভাবতে কেমন লাগছে?
সত্যি ভাবতে অবাক লাগছে! বুঝতেই পারছি না এতোটা বছর কিভাবে গানের সঙ্গে কেটে গেলো। আমি মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতি অসম্ভব কৃতজ্ঞ। তিনি আমাকে যে জীবনটা দিয়েছেন, তার কোন তুলনা হয় না। সৃষ্টিকর্তার রহমত, বাবা মায়ের সহযোগীতা এবং আমার গুরুদের আশির্বাদে এতোটা পথ পাড়ি দিতে পেরেছি।
আজ অন্তর থেকে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করছে আমার ভক্ত-দর্শক-শ্রোতাদের। তারা আমার গান পছন্দ করেছেন সারাটা জীবন। তাই আমি এখনো গেয়ে যাচ্ছি। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের কাছ থেকে যে ভালোবাসা, সমাদর আর শ্রদ্ধা আমি পেয়েছি তা বর্ননা করা যাবে না। এমন ভালোবাসা ক’জনের ভাগ্যে জোটে আমি জানি না।
সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন যেন আজীবন এভাবে গেয়ে যেতে পারি। এখনো অনেক গান করতে চাই। আরও ভালো ভালো কিছু গান সবাইকে উপহার দিতে চাই।
স্কুল জীবন থেকেই পেশাদার শিল্পী হিসেবে পথচলা আপনার। যখন শুরু করেছিলেন তখন কি ভেবেছিলেন ছয় দশক পরও মানুষ আপনার গান শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে বসে থাকবে?
(মৃদু হাসি) একদম ভাবিনি। এটা আসলে কেউ ভাবতে পারেও না। কারণ ভবিষ্যতে কি হবে সেটা তো আমরা আগে থেকে জানতে পারি না। তবে এটা স্বপ্ন দেখতাম, একদিন সবাই আমার গান পছন্দ করবে, আমাকে গানের মাধ্যমে ভালোবাসবে।
ইউনিক গায়কীর জন্য আপনি প্রসিদ্ধ। এই গায়কী কতো শতাংশ সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত আর কতো শতাংশ চর্চার ফসল বলে মনে করেন?
গান আসলেই সাধনার বিষয়, গুরুমূখী বিদ্যা। তবে অনেকে কোন তালিম ছাড়াও গাইতে পারেন। তার মানে সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত একটা বিষয় আছে আর চর্চারও একটা বিষয় আছে। সৃষ্টিকর্তা কাউকে গলায় সুর না দিলে চেষ্টা করেও সুরেলা করা যায় না। তবে কারও সুর ভালো হলেই হয় না। প্রতিনিয়ত চর্চা ও সাধনার ফলে কণ্ঠ শাণিত হয়। তখন সেই কণ্ঠে গান হয়ে ওঠে মোহনীয়।
৬০ বছর পার করার পরও আপনি আপনার গায়কী ধরে রেখেছেন। যেটা অনেক শিল্পীর ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। এটি কিভাবে হয়েছে?
আমি আসলে জীবনটা বহুকাল আগে থেকেই ডিসিপ্লিনের মধ্যে এনেছি। শুধু নিয়ম করে গলা সাধলেই হয় না। পুরো জীবনপ্রণালী হতে হয় নিয়মতান্ত্রিক। এক্ষেত্রে সারগাম করা যেমন ইমপরটেন্ট, তেমনি রয়েছে খাদ্যাভ্যাস, শরীরের প্রতি যত্নশীল হওয়া, মোস্ট ইমপরটেন্টলি মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নবান হওয়া। শিল্পীকে দীর্ঘকাল তার শিল্পস্বত্তার মধ্যে নিবিষ্ট থাকতে হলে তার চারপাশটা সুস্থ ও সুন্দর রাখতে হয়। পজিটিভ চিন্তা ভাবনা, পজিটিভ এনার্জির সঙ্গে ওঠাবসা করা এবং নিজেকে প্রতিনিয়ত ইমপ্রুভ করার মানসিকতা থাকতে হয়।
আমি মনে করি, গানের মহাসমূদ্রে আমি কেবল তীরে এসে পৌঁছানো এক মুসাফির! এখনো কতোকিছু শেখার বাকী। এখনো আমি শিখে চলেছি। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত শিখে যাবো, আর নতুন সৃষ্টিতে সেই শিক্ষা কাজে লাগিয়ে যাবো। এই কাজটি করি বলেই হয়তো দর্শক আমার গান এখনো পছন্দ করেন, আমাকে নতুনভাবে ফিরে পান।
আপনার গান অসংখ্য শিল্পীর অনুপ্রেরণা। আপনি কোন শিল্পীর গান শুনে অনুপ্রাণীত হতেন?
লতাজি’র (লতা মঙ্গেশকর) কথা সবার আগে বলতে হয়। এছাড়া আশাজি (আশা ভোসলে), নুরজাহান ও আমাদের দেশের ফেরদৌসী রহমান আপা, আঞ্জুমান আরা আপার কথা বলতেই হয়। লতাজি-আশাজি’র সঙ্গে আমার সম্পর্ক হয়ে উঠেছিল পরিবারের মতো। লতাজি চলে যাওয়ার আগে প্রায় প্রতিদিনই তার সঙ্গে ওয়াটস্যআপে ইন্টার্যাকশন হতো। যেদিন কথা বলতাম অনেক লম্বা হতো সেই আলাপ। এখন আশাজির সঙ্গেও একই রকম যোগযোগ রয়েছে।